×

জাতীয়

জনবলের অভাব: রেলের ১৩১ স্টেশন বন্ধে সুবিধাবঞ্চিত কোটি মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৮:৩৭ এএম

দেশে মোট ৪৬৬টি রেলস্টেশনের মধ্যে স্টেশন মাস্টার, সিগন্যালম্যানসহ অন্যান্য জনবলের অভাবে ১৩১টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন। যার ফলে কোটি মানুষ রেলসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এর ফলে রেলওয়ে যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনি চুরি হয়ে যাচ্ছে বন্ধ স্টেশনগুলোর দরজা, জানালাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।

রেলওয়ে বলছে দীর্ঘদিন ধরে জনবল, পরিকাঠামোগত সংকটে এসব স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এর আগে প্রায় ১৬৫টি স্টেশন বন্ধ ছিল। সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের সময় বেশ কিছু স্টেশন চালু করা হয়। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, কিছু স্টেশন বিএনপি আমলে বন্ধ করা হয়, রেললাইনও উঠিয়ে নেয়া হয়। তাছাড়া কর্মী সংকটের কারণে বেশ কিছু স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু চালু করা হয়েছে, কিছু প্রক্রিয়াধীন। তবে রেলওয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি সম্পন্ন হলে আমরা বেশ কিছু স্টেশনে কর্মী নিয়োগ করে চালু করব।

রেলসূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট স্টেশন সংখ্যা ৪৬৬টি। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ২৩৮টি স্টেশনের মধ্যে ৬৯টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। আর পূর্বাঞ্চলের ২২৮টি রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে ৬২টি স্টেশন (বি এবং ডি ক্লাস) দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

রেলের পশ্চিমাঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, পাকশি রেল বিভাগে ৪৭টি এবং লালমনিরহাট বিভাগে ২২টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ২২৮টি স্টেশনের মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৬২টি। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীদের প্রয়োজনের নিরিখেই এসব রেল স্টেশন স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু স্টেশন মাস্টার ও অন্যান্য জনবলের অভাবে এসব স্টেশন সচল রাখা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো স্টেশন ১০ বছর ধরেই বন্ধ। ট্রেন না থামায়, রেলওয়ের কর্মী না থাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া অধিকাংশ স্টেশন পরিত্যক্ত হয়েছে। কার্যকর তদারকির অভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে রেলের মূল্যবান সরঞ্জাম।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা-চট্টগ্রাম) ২২৮টি স্টেশনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৪৩টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৫টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে মোট ৬২টি স্টেশন (বি এবং ডি ক্লাস) দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ ৬২ স্টেশনের মধ্যে মেইন লাইনে ৫০টি এবং শাখা লাইনে ১২টি স্টেশন রয়েছে। লোকবল সংকটের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগে বি-ক্লাস স্টেশনের মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে ভাটিয়ারী, বাড়বকুণ্ড, বারৈয়াঢালা, মীরসরাই, মস্তাননগর, মুহুরীগঞ্জ, কালীদহ, শর্শদী, নাওটি, আলি শহর, ময়নামতি, রাজাপুর, মন্দবাগ, খিলা, দৌলতগঞ্জ, বজরা, শাহতলী, ঝাউতলা, সরকারহাট। আর আংশিকভাবে বন্ধ রয়েছে হাসানপুর, চিতোষী রোড ও মেহের স্টেশন।

অন্যদিকে ঢাকা বিভাগে বন্ধ স্টেশনগুলো হলো- বেগুনবাড়ী, বাউসি, কালিয়াপ্রসাদ, লস্করপুর, টিলাগাঁও, ভাটেরাবাজার, খাজাঞ্চিগাঁও, আফজালাবাদ, ইজ্জতপুর, নরসিংদী, সুতিয়াখালী, নীলগঞ্জ, মোশারফগঞ্জ, ঠাকুরাকোনা, ইটাখোলা ও বিষকা। একই বিভাগে আংশিকভাবে বন্ধ স্টেশনের মধ্যে রয়েছে কেন্দুয়া, জামালপুর, ছাতকবাজার, শহীদনগর, বারৈপটল, হরষপুর ও বারহাট্টা। প্রতিটি বি-ক্লাস স্টেশনে সর্বনিম্ন তিনজন স্টেশন মাস্টারের প্রয়োজন। তবে ডি-ক্লাস স্টেশন পরিচালনায় শুধু বুকিং ক্লার্ক থাকলেই হয়। কিন্তু স্টেশন মাস্টারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বুকিং সহকারী না থাকায় এসব স্টেশন বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল জোনের সদ্য অবসরে যাওয়া মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মিহির কান্তি গুহ বলেন, স্টেশন মাস্টার ও পয়েন্টস ম্যানের স্বল্পতার কারণে স্টেশনগুলো বন্ধ রয়েছে। প্রয়োজন ছিল বলেই এসব স্টেশন স্থাপিত হয়েছিল। তিনি বলেন, জনবল সংকট কেটে গেলে এসব স্টেশন আবার অপারেশনে আসবে। আমরা বর্তমানে ৪১ শতাংশ কম জনবল দিয়ে এ অঞ্চলের রেল চালাচ্ছি।

অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলেও ১০ বছর ধরে অনেক স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এসব স্টেশন সচল করার উদ্যোগও আপাতত নেই। এতে একদিকে যাত্রীরা যেমন চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘদিন রেলস্টেশনগুলো বন্ধ থাকায় প্রতিনিয়ত রেলওয়ের মূল্যবান সম্পদ চুরিও হচ্ছে। এছাড়া শিল্পকারখানা ও চা বাগানবেষ্টিত কয়েকটি রেলস্টেশন বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় আছে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, রেলে জনবল সংকট রয়েছে সারাদেশে। সত্তরের দশকে সারাদেশে রেলের লোকবল ছিল প্রায় ৬৮ হাজার। যা কমতে কমতে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ২৪-২৫ হাজারের মতো। এরই মধ্যে রেলের অনেক স্টেশন বন্ধও রয়েছে। এসব বন্ধ স্টেশন চালুর জন্য রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলোচনাও চলছে। নতুন জনবল যোগ হলে পর্যায়ক্রমে এসব স্টেশন চালু হবে বলেও জানান তিনি। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এখানে নতুন জনবল নিয়োগ না হলেও বছরের কোনো না কোনো সময় অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরে যাওয়ায় ২০২২ সালের মধ্যে আরো অনেক রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে যাবে।

সর্বশেষ ২০২০ সালে রেলের জন্য আগের তুলনায় ১০ হাজারের বেশি জনবল বাড়িয়ে মোট ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনবল অনুমোদন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নিয়োগ নিয়ে ২৮টি মামলা থাকায় জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। সম্প্রতি মামলাগুলো খারিজ হওয়ায় বন্ধ নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে।

জানা যায়, রেলে বর্তমানে কর্মরত আছে ২৪ হাজারের কিছু বেশি। নতুন অনুমোদিত জনবলের বিবেচনায় রেলে সাড়ে ২৩ হাজার পদ শূন্য রয়েছে। এই না থাকা জনবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই কারিগরি পদের, যাদের দরকার হয় ট্রেন চালানো, লাইন দেখাশোনা বা সিগন্যালের কাজে। লোকবলের অভাবে নতুন করে রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পুরনো দক্ষ কর্মীরা চলে যাচ্ছেন অবসরে। এই লোকবল সংকটের প্রভাব সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে রেলওয়ের জন্য।

রেলসূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৮ সালে কিছু জনবল নিয়োগ করা হয়েছিল। এরপর নানা জটিলতায় নিয়োগ আটকে আছে। গত ১১ বছরে সারাদেশে নতুন স্টেশন নির্মাণ হয়েছে ৯৫টি। আর ১৩৩টি নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। তবে নিয়োগ হয়নি জনবল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App