×

অর্থনীতি

মিনিকেট-নাজিরশাইল চালের নামে চালবাজি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২২, ০৮:২৬ এএম

মিনিকেট-নাজিরশাইল চালের নামে চালবাজি

চাল/ ফাইল ছবি

চালের দোকানে ঢুকেই প্রথমে একজন ক্রেতার চোখ খুঁজতে থাকে ঝকঝকে সাদা মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইল চাল। চড়া দামে কিনে বাড়িতে নিয়ে রান্নার পর ভাত যদি খেতে ভালো না লাগে কিংবা বেশি সেদ্ধ হয়ে যায়; ক্রেতা ধরেই নেন এটা রান্নার গাফিলতি।

অটোমেটিক মেশিনে মোটা চাল ছাঁটাই হয়ে চিকন চালে পরিণত হচ্ছে। দেখতে চিকন, ফর্সা এবং চকচকে। নাম দেয়া হয়েছে মিনিকেট। ‘মিনিকেট চাল’ এতটাই জনপ্রিয় যে শহরে তো বটেই, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষও খাওয়ার পাতে তুলে নেয় এটি। বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে এসব চালে। প্রায় আড়াই দশক ধরে মিনিকেট চাল বাজারে তার আধিপত্য ধরে রেখেছে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাংলার মাঠে মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্বই নেই। এদিকে মিনিকেট চালের নামে সস্তা চাল বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ লাভ করছেন মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও নাজিরশাইল কিংবা মোটা চালও চলছে পাশাপাশি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব নামের কোনো ধানের আবাদ যেমন দেশের কোথাও নেই, তেমনি এগুলো কেউ আমদানিও করে না।

কৃষি বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ধানের মাঠ আর বাজার সয়লাব থাকে ব্রি ধানে, কিন্তু বাজারে ব্রি চাল নামে কোনো চালের অস্তিত্ব নেই। আবার দেশে এখন বিপুল পরিমাণ হাইব্রিড ধান উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ বাজারে হাইব্রিড ধানের চাল বলে কিছু পাওয়া যায় না। ছাঁটাইয়ের কারণে পুষ্টিগুণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নামিদামি কোম্পানিগুলোও এ চাল বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ অবস্থায় সরকার বলছে, মিনিকেট, নাজিরশাইলের ব্র্যান্ডিং দেশে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করছে তারা।

মিনিকেট চাল বানানোর যান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেছে, অটোরাইস মিলে এমন অতিবেগুনি রশ্মি রয়েছে যার ডিজিটাল সেন্সর চাল থেকে সব কালো বা নষ্ট চাল, পাথর, ময়লা সরিয়ে ফেলে। তারপর এ চাল চলে যায় অটোমিলের বয়লার ইউনিটে। সেখানে ৫টি ধাপে পলিশ করার মাধ্যমে মোটা চাল সাদা রং ধারণ করে। এর পর পলিশিং মেশিনে মোটা চাল কেটে চিকন করা হয়। আর চকচকে করার জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন কেমিকেল। রাজধানীতে জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সম্মেলন শেষে গত শুক্রবার (১১ মার্চ) স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র

মজুমদার বলেছেন, মিনিকেট আর নাজিরশাইল বলতে কোনো ধান নেই। অন্য জাতের ধানকে এসব ধানের চাল বলে বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যে সরু চাল খাওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে জিরাশাইল, শম্পা কাটারি- এ দুই ধানই বেশি। এ ধানকেই মিনিকেট বলে চালাচ্ছে। আবার ২৮-কেও মিনিকেট বলে চালায়, ২৯-কেও মিনিকেট বলে চালায়, আর আমরাও (জনগণ) মিনিকেটই খুঁজি। এছাড়া নাজিরশাইল বলেও কোনো ধান নেই। এজন্য সবাইকে সাদা স্বচ্ছ চালের পরিবর্তে লাল চাল খাওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি। এ সময় তিনি মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে চাল বিক্রির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন। একই অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, নতুন নতুন কোম্পানি মিনিকেট ও নাজিরশাইলের প্যাকেট করে চড়া দামে বিক্রি করছে। মুনাফার জন্যই বিভিন্ন কোম্পানি মোটা চাল কেটে সরু করে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে বিক্রি করছে ৮২ টাকা পর্যন্ত কেজিতে। এটি সরাসরি প্রতারণা। অবৈধ মজুতদারিরোধে করণীয়সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে গত রবিবার (২০ মার্চ) খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশে চালের বাজার অস্থিরতার পেছনে গুটিকয়েক মিলার দায়ী। বিশেষ করে কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুডের মালিক ও বাংলাদেশ অটো মেজর হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদসহ দেশের ৫ জন মিলার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের ইচ্ছের ওপরই বাজার দর নির্ধারণ হয়। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। এদিকে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সংস্থা, খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ২০২০ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, আধুনিক অটো রাইস মিলের মালিকরা মেশিনের মাধ্যমে চালের আকার পরিবর্তন করেন এবং পলিশ করে চালকে চকচকে রূপ দেন। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রাইস মিলিং’। এর ফলে কোন চাল কোন ধান থেকে এসেছে তা বোঝার আর কোনো উপায় থাকে না ক্রেতার। এফপিএমইউ প্রকাশিত ২৫ পৃষ্ঠার ওই গবেষণাতে বলা হয়, যেহেতু রাইস মিলিং বা চালের আকার-আকৃতি বদলানো এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই; তাই তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে যাচ্ছে এবং ক্রেতাদের এই চাল কিনতে বাধ্য করছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গাজীপুরের ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা এবং শেকৃবির কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের পিএইচডি ফেলো কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন ভোরের কাগজকে জানান, দেশে ধান গবেষণার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ব্রি গত প্রায় তিন দশক ধরে এ নিয়ে ভোক্তা সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে আসছে। দেরিতে হলেও সরকার এখন এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি হাইব্রিড ধান ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বস্তায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে এ চালের ব্যাপক চাহিদার জন্য ‘মিনিকেট’ নামে প্রতারণার ব্যবসা চলছে জমজমাট। আসলে ১৯৯৫ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের কৃষি বিভাগ নতুন জাতের চিকন ‘শতাব্দী’ ধানবীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদের এ ধানবীজের সঙ্গে আরো কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি মিনি প্যাকেট দেয়া হয়। ওই মিনি বা ছোট প্যাকেটটাকে বলা হতো ‘মিনি কিটস’। সেখান থেকেই ‘শতাব্দী’ ধানের নাম হয়ে যায় ‘মিনিকেট’। তবে নামের পেছনে ঘটনা যা-ই থাক, মিনিকেট নামে কোনো চালের জাত দেশে নেই এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টিবিভাগের সিএসও এবং প্রধান ড. মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী ভোরের কাগজকে বলেন, ওভার পলিশ ও বেশি ছাঁটাইয়ের কারণে জিংকের পরিমাণ অনেক কমে যায় এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এছাড়া কিছু কিছু ধানের পুষ্টি উপাদান নাটকীয়ভাবে কমে যায় এবং কোনো কোনো চালে শুধু শর্করাই থাকে। মোহাম্মদ আলি সিদ্দিকী বলেন, যে চালে গ্লাসইসেমিক ইনডেক্স যত বেশি, সেই চাল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য তত বেশি ক্ষতিকর। গ্লাাইসেমিক ইনডেক্স কম হলে যেটা বাদামি চালে আছে তাতে রক্তের শর্করা আস্তে আস্তে বাড়ে। সাদা চালের ভাত খাওয়াতে ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

এদিকে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের নামে অন্যান্য জাতের চাল বিক্রি করার কথা স্বীকার করেছেন রাইস মিলাররাও। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, আমরা যদি এটাকে মিনিকেট নামকরণ না করি, তাহলে ক্রেতারা এটা কিনবে না। মানুষ খাওয়ার টেবিলে মিনিকেট চালের ভাত চায় বলেই আমরা এর নাম দিয়েছি মিনিকেট।

নাজিরশাইল, কাজল লতা নামেও চাল আছে ধান নেই : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে মূলত ধান তিন ধরনের- আউশ, আমন ও বোরো। আর ধানের অর্ধেকেরও বেশি হলো বোরো জাতের, যেগুলোর পরিচিত ব্রি হিসেবে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে এ ব্রি ধানের দুটি জাত থেকেই বেশি ধান পাওয়া যায়। অথচ বাজারে ব্রি নামে কোনো চাল নেই। মূলত ব্রি ২৯ ধানটি ছাঁটাই করে ও অতিমাত্রায় পলিশ করে নাজিরশাইল নাম দিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। নাজিরশাইলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে নাইজার শাইল ধান আছে, কিন্তু সেটা আবার বাজারের যে পরিমাণ নাজিরশাইল চাল পাওয়া যায় সে পরিমাণ ধান হয় না। অর্থাৎ মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইলের মতো নাইজার শাইল নামে যা পাওয়া যায় তারও একটি বড় অংশ আসলে মোটা ধান কেটে ও পলিশ করে তৈরি করা।

চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় উচ্চ আদালতের কাছে একটি লিখিত পিটিশন দায়ের করে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ‘মিনিকেট’ ও ‘নাজিরশাইল’ চাল প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী সবগুলো রাইস মিলারের তালিকা দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়। চালের আকৃতি পরিবর্তন ও পলিশিংয়ের ফলে চালের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে কিনা এবং তা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি কিনা জানিয়ে চার মাসের মধ্যে একটি গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশও দেয় হাইকোর্ট। তাছাড়া, কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি চাল তৈরি ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে সরকার কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করে আদালত।

চাল ছাঁটাই নীতিমালা : চালকল মালিক, মিলার ও আড়তদারদের প্রতারণা প্রতিরোধে অবশেষে চাল ছাঁটাই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে সম্মতি দিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ব্রির বিজ্ঞানীরা। এখন থেকে চালের নামের পরিবর্তে বাজারজাত বস্তার গায়ে ধানের নাম ও জাত লিখতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে, যাতে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতারণা বন্ধ করা যায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ নাজমানারা খানম ভোরের কাগজকে জানান, চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরি করতে চান তারা। ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাজা আবদুল হান্নানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সচিব বলেন, আমরা প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিলিং প্রক্রিয়াও দেখব। তারপর আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করব। নাজমানারা খানম মনে করেন, গাইডলাইন তৈরি যখন সম্পন্ন হবে, তখনই সরকারের পক্ষে অসাধু মিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App