গণপরিবহনে বেশি ভাড়া আদায়: নৈরাজ্য রোধে নেই তদারকি
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২২, ০৮:৫৬ এএম
বিআরটিএর নির্ধারিত বাস ভাড়া আদায়ের নির্দেশনা মানছেন না পরিবহনকর্মীরা। এখনো ৩ টাকা থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা নিয়ে বাস কন্ডাক্টর, চালক ও হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের প্রতিদিনই বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। কোনো বাসেই ভাড়ার তালিকা টানানো দেখা নেই। যাত্রীরা ওয়েবসাইট থেকে ভাড়ার তালিকা কন্ডাক্টরকে দেখানোর পরও তারা এই তালিকা মানতে নারাজ।
সরজমিন দেখা গেছে, মহাখালী থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাব করলে মোট ২০ টাকা ভাড়া হয়। কন্ডাক্টররা এই দূরত্বে ভাড়া নিচ্ছেন ২৫ টাকা। বাড্ডা থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। ভিক্টর পরিবহনের বাসে এই দূরত্বে ভাড়া রাখা হয় ২৫ টাকা। অথচ এই রুটের ভাড়া হওয়ার কথা ২০ টাকারও কম। তবে যাত্রীরা ২০ টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরও কন্ডাক্টরের সঙ্গে যাত্রীদের বাকবিতণ্ডা হচ্ছে প্রতিদিনই। যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণও করা হচ্ছে। সরকারের ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী মোহাম্মদপুর থেকে গুলিস্থানের ভাড়া আসে ১৬ টাকা। কিন্তু ২০ টাকাই ভাড়া দিতে হচ্ছে, এর কম দিলেই হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটছে। মোহাম্মদপুর থেকে ঝিগাতলা পর্যন্ত আগে ৫ টাকা ভাড়া ছিল। বাড়ানোর পর ৭ টাকা হয়েছে, কিন্তু নেয়া হচ্ছে ১০ টাকা ভাড়া।
ব্যবসায়ী ওয়ালিউর রহমান নামে এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, তরঙ্গ পরিবহনের বাসে মোহাম্মদপুর থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা, মোহাম্মদপুর থেকে চলাচল করা মালঞ্চ পরিবহন, মিডলাইন পরিবহনে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। অথচ একই রুটে বিআরটিএ এর তালিকা অনুযায়ী ভাড়া হবে ১৬ টাকা। নগর পরিবহনের সব বাসেই ১৬ টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এভাবে বাড়তি ভাড়া নেয়া হলেও যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কেউ নেই, সরকারের কোনো তদারকিও নেই।
মিডলাইন পরিবহনের কন্ডাক্টর রফিক জানান, ভাড়া আসলে বাড়ানো হয়নি। আগে গুলিস্তান পর্যন্ত ২০ টাকা ভাড়া নেয়া হতো, এখনো ওই ২০ টাকাই নেয়া হচ্ছে। হাফ পাস কাটা হচ্ছে। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হয়। সরকারের তালিকা দেখে ভাড়া নেয়া সম্ভব নয়।
ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা শুরু হলেও যাত্রীরা ভাড়ার তালিকা দেখতে চাইছেন। কিন্তু বাসের ভেতরে এখন আর কোনো তালিকা খুঁজে পাওয়া যায় না। যাত্রীরাও এখন আগের চেয়ে সচেতন। অনেকেই বিআরটিএ এর ভাড়ার তালিকা মোবাইলে সেভ করে রাখেন। তারাও তালিকার চেয়ে বেশি ভাড়া দিতে নারাজ। প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ১৫ পয়সা ধরে হিসাব করে রাস্তার দূরত্ব দেখে ভাড়া নিতে বাধ্য করছেন। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা অনেক সময় হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
বাড্ডা লিংক রোড থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ৮ কিলোমিটারের ভাড়া আসে প্রায় ২০ টাকা। যাত্রীদেরও ২০ টাকা ভাড়া দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাসে জোর করেই ২৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এই রুটের সব গণপরিবহনেই ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের বাকবিতণ্ডা নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। এই রুটের যাত্রী মাহমুদ হাসান বলেন, বাসগুলো সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা মানছে না। ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। এ নিয়ে প্রতিদিনই হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে।
অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে। শতভাগ না হলেও ৯০ শতাংশ গণপরিবহনে বিআরটিএ নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ভাড়ার নৈরাজ্য ঠেকাতে আমাদের টিম কাজ করছে। যেসব পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে আমরা সেসব কোম্পানির মালিকদের ডেকে সতর্ক করছি।
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, এখনো যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখছে না। বেশি ভাড়া আদায়ে পরিবহন শ্রমিকরা সব সময়ই বেপরোয়া। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে তারা একটু দমে থাকে, তারপর আবারো স্বরূপে ফিরে আসে। পরিবহন সেক্টরে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এখনো যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আছে। ভাড়া নৈরাজ্যসহ পরিবহন সেক্টরের অনিয়ম বন্ধে আমরা ইতোপূর্বে সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছি। কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হলে ভাড়া নৈরাজ্য কমবে। যাত্রীদের সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে প্রতিবাদ করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা হাফ পাস কার্যকর করতে চায়নি। কিন্তু সরকারের নির্দেশে তা কার্যকর করেছে। ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধেও সরকারকে কঠোর হতে হবে।