×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধু, একটি দেশ ও একটি জাতির ইতিহাস

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২২, ১২:২৫ এএম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আন্দোলন থেকে একটি সংগ্রাম এবং সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি একটি দেশ ও একটি জাতির ইতিহাস। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়সম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক। পলাশী ট্র্যাজেডির পর দীর্ঘ ১৯০ বছর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির শাসন-শোষণ, পীড়ন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা থেকে মুক্ত হয়েছিল ভারতবর্ষ। সেই দুই শতাব্দী সময়ে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় ঘটে গেছে অনেক ব্যর্থ লড়াই সংগ্রামের ঘটনা। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সিপাহি বিদ্রোহ এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চলেছে বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে মাঝে। পরাধীনতার শেকল ছেঁড়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাগুলো সর্বজনীন হতে পারেনি নানা রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক কারণে। তিতুমীর থেকে সূর্যসেন। এর মাঝে ঘটেছে অসংখ্য বীর প্রাণের আত্মাহুতি। কিন্তু সেসব লড়াই ছিল অসংগঠিত, ঐক্যহীন সংগ্রাম। এতে শুধুই জীবনক্ষয় হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়নি ভারতবর্ষে। হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় জাতি বিভাজনের ফলে সেই মুক্তির লড়াইগুলো বারবার ব্যর্থ হয়েছে। চতুর সামরিক শক্তি এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির দমন প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে স্বাধীনতাকামী ভারতীয় জনগণের সব কৌশল এবং বারবার ফাঁসির বেদিতে জীবন দিতে হয়েছে তরুণ তাজা বিপ্লবীদের। ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলেও বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এই দীর্ঘ সময়ে ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছেন দেশপ্রেমী অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাশাপাশি বাঙালি সুভাষ বসু, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ মহাপ্রাণ নেতার আবির্ভাব ঘটলেও অবিভক্ত বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বরং দ্বিজাতিতত্ত্বের যুপকাষ্ঠে বলি দিতে হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে। বাংলার পূর্বাংশ এই বাংলাদেশ পাকিস্তান নামের অদ্ভুত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয়ে ধুঁকতে থাকল শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের জাঁতাকলে। এক সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক মহাপুরুষের জন্য উদগ্রীব ছিলেন, যে এসে দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত করবে, স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করার সুযোগ এনে দেবে, স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে। কবিগুরু উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান করেছিলেন ‘জনগণমন অধিনায়ক আসে…।’ না সেই ভারত ভাগ্য বিধাতার আবির্ভাব ঘটেনি সেই সময়ে- যে অখণ্ড স্বদেশভূমির স্বাধীনতা এনে দেবে। তবে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় আক্ষেপ- ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি…’ এই ভাবনাটি খণ্ডন করতে আবির্ভূত হলেন এক বাঙালি মহাপ্রাণ। জল-কাদায় ভেজা, নদী-হাওরে ঘেরা পূর্ববাংলার এক অজগ্রাম টুঙ্গিপাড়ার মৃত্তিকা থেকে উত্থিত হলেন তিনি। হয়তো এই মানুষটিই রবি ঠাকুরের সেই অনাগত অধিনায়ক-অখণ্ড ভারতের মুক্তিদাতা হয়ে উঠতেন, যদি তাঁর জন্ম আরো ৫০ বছর আগে হতো। হয়তো হয়নি, কিন্তু তিনি যুগ-যুগের শোষিত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিভূ হয়ে ওঠেন। জাতিকে উপহার দেন একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। না, তিনি হঠাৎ করে নেতা হয়ে ওঠেননি। মাটি-মানুষের নেতা হিসেবে তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জেল, জুলুম, নির্যাতন সয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে অবিচল রেখেছেন। কঠিন-বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। মৃত্যুকে নির্ভয়ে অতিক্রম করেছেন। দেশপ্রেম, সততা, সৎসাহস এবং জাদুকরি নেতৃত্বগুণে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং সর্বশেষ জাতির পিতা হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু জীবনভর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন অবসানের লক্ষ্যে লড়াই করেছেন এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রাম করে এগিয়ে গেছেন জাতিমুক্তির পথে। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তাধারা, চমৎকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আপসহীন নেতৃত্ব, সৎসাহস তাকে মহান নেতা হিসেবে, বাঙালির ঘরে ঘরে মহানায়ক হিসেবে অনন্য এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর অনেক সংগ্রাম এবং ভাবনার ফসলই আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র- বাংলাদেশ। বাঙালি মাত্রই জানেন তাঁর আপসহীন আর অসীম সাহসী লড়াইয়ের কথা। ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও বঙ্গবন্ধু তাঁর অবস্থান থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে গেছেন। গোটা জীবনে শেখ মুজিবুর রহমানের একটাই ছিল অবাধ্য : স্বাধীন বাংলাদেশ। তার একটাই প্রতিজ্ঞা ছিল- সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আর ৫৬ হাজার বর্গমাইল জায়গা বাঙালির জন্য চাই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্যরা বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, হিংস্রতা আর নির্মমতার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছিল। তখন তারা বন্দি করে নিয়ে যায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ সম্পদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় অনেক রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। বর্বর নির্মম শাসক-শোষক হায়েনা পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির নয়নমণি, হৃদয়ের স্পন্দন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানে বন্দি। বিশ্বজনমতের চাপে এক সময় তারা মুক্তি দিতে বাধ্য হলো বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নেতাকে। তিনি তার চির আরদ্ধ স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন চির উন্নত শিরে, উদ্ধত জয় বাংলা উচ্চারণে। আমাদের সবাইকে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উপলব্ধি করার পাশাপাশি গভীরভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সবাইকে এ কথা মানতে হবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। আজ আমাদের বেশি কিছু চাওয়া নেই। আমরা সর্বান্তকরণে চাই সব দল ও সংগঠন এবং গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাবে, তাঁর শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে, তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করবে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধু কেবল আওয়ামী লীগের নন, তিনি বিশেষ কোনো শ্রেণি ধর্ম কিংবা বর্ণের নন, তিনি দেশের সব মানুষের, তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু কোনো দলের সম্পদ নন, সমগ্র জাতির সম্পদ। তিনি বাংলার নয়নমণি, বাংলার হৃদয়ের স্পন্দন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়াপত্তন থেকে বঙ্গবন্ধু প্রতিটি অধ্যায়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন অসামান্য অবদানের মাধ্যমে। ধাপে ধাপে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অপূর্ব বিচক্ষণতায়। তার নেতৃত্বে অদ্ভুত কারিশমা ছিল, ফলে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে একজন নির্ভরযোগ্য কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ তাকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল নিঃসংকোচে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন সংগ্রামমুখর জীবনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই নানা নাটকীয়তা আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশে পরিপূর্ণ। আজকের তরুণ প্রজন্ম অনেকটাই রাজনীতিবিমুখ। তাদের রাজনীতিবিমুখতার কারণও রয়েছে যথেষ্ট। গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক শঠতা আর অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে এটা সত্যি। তবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন যদি আজকের তরুণরা আন্তরিকভাবে চর্চা করে, তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়গুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যথার্থ বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয় তাহলে আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ পাল্টে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। দীর্ঘদিন স্বৈরাচারী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে দেশ জিম্মি থাকায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কটাক্ষ করা হয়েছে। তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। ফলে বিভ্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশের অনেক মানুষ। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায়। ষড়যন্ত্রকারী মিথ্যা অপপ্রচারকারীদের দিন শেষ হয়েছে। দেশের মানুষের কাছে এখন সত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা অনুসারী থাকতে পারে। যে যে দলই করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক কিংবা বিভেদ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে নেয়া উচিত সবার। শিশু শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে পাঠ্য বইয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়কে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে হবে। জাতির জনক হিসেবে তিনি এক অনন্য শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। তিনি কেমন মানুষ ছিলেন, কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, তিনি কী চেয়েছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কী ছিল, তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক চিন্তাধারা সবই তুলে ধরতে হবে সৃজনশীল, নিরপেক্ষ লেখায়। শুধু কঠিন প্রবন্ধ কিংবা কাব্যরচনা করে নয়, সব শ্রেণির সব বয়সের মানুষের উপযোগী করে লিখতে হবে। ফলে শৈশব থেকেই নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে জেনে-বুঝে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, চিন্তাভাবনা সম্পর্কে গভীরভাবে পরিচিত হয়ে বড় হবে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু সর্বজনীনতা পাবেন। পঁচাত্তরের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথেষ্ট অসতর্ক, বেপরোয়া ও বিদ্বেষপ্রসূত বিতর্ক হয়েছে। আবার কোনো মহল ইচ্ছা করেই এমনটি করেছে। আজ সময় এসেছে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুকে গোটা জাতির কাছে সম্মানজনক অবস্থানে তুলে ধরা। বিভেদ আর বিদ্বেষ আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। এখন আর আমরা পিছিয়ে থাকতে চাই না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে গোটা দেশের সব দলের সব মতের মানুষের কাছে সর্বজনীন এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা এখন আমাদের সবার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App