×

জাতীয়

বৈশ্বিক চাপ এড়ানোর কৌশল মিয়ানমারের!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২২, ০৮:২৩ এএম

বৈশ্বিক চাপ এড়ানোর কৌশল মিয়ানমারের!

মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী মিন অং হ্লেইং

মাত্র সাতশ রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার মাধ্যমে আলোচিত প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় জানিয়ে ঢাকাকে আচমকা চিঠি দিয়েছে নেপিদো। অবশ্য ঢাকা চায় পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসন। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে হঠাৎ চিঠি দেয়ায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একে পাত্তা দিতে নারাজ। তারা বলেছেন, উদ্ভট এক চিঠি দিয়ে মিয়ানমার নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে। পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাইছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায়। কিন্তু সেই চিঠিই প্রশ্ন তুলে বলে দিল, রোহিঙ্গা ফেরাতে তাদের আন্তরিকতা কতটুকু? এভাবে কোনোদিন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। ‘বিশ্ব’ থেকে নজর ঘোরানোর জন্যই মিয়ানমার এই চিঠি নাটকের জন্ম দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলেছেন, মিয়ানমারের সাড়াদানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপে মিয়ানমারকে ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে ৭০০ রোহিঙ্গা নিতে প্রস্তাব দিয়েছে নেপিদো। মিয়ানমারের প্রস্তাব মতে রোহিঙ্গা ফেরানোর প্রক্রিয়ায়, কোনো পরিবারের বাবা গেলেও, স্ত্রী যেতে পারবে না। আবার ছেলে গেলে ছেলের বউ যেতে পারবে না। সব মিলিয়ে প্রত্যাবাসনের এই প্রক্রিয়ায় পরিবারের সদস্যদের আলাদা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠাবে না বাংলাদেশ। এর ফলে যে কোনো মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা বললেও সহসাই তা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন না। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতি থাকলেও ঢাকা-নেপিদোর দুই মতের কারণে তা প্রলম্বিত হবে।

জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, চিঠির বিষয়টি আমিও শুনেছি। ভবিষ্যতে কী হবে তা জানতে অপেক্ষা করার পরমর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত হবে তা সবই জানতে পারব। কাজেই পুরো চিত্র বুঝতে হলে একটু সময় নিতে হবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের পাঠানো প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় মিয়ানমার নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের প্রত্যাশা, পর্যায়ক্রমে সব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পরিচয় নিশ্চিত করে নিয়ে যাবে। ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা ইতোমধ্যে মিয়ানমারকে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রক্রিয়াটিকে বেশ ধীরগতির বলে জানিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে পরিবারভিত্তিক চিহ্নিত করা হয়েছে। মিয়ানমার এদের মধ্যে ৭০০ জনকে নেয়ার প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব এখনো পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করা হয়নি। তবে যতটুকু দেখা গেছে, তাদের প্রস্তাবে পরিবারের সদস্যরা আলাদা হয়ে যায়। আমরা পরিবার ভেঙে রোহিঙ্গাদের পাঠাতে চাই না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যদি পরিবার থেকে আলাদা করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়, তবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যেতে চাইবে না। আমরা কোনো নেতিবাচক কথা রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে শুনতে চাই না। আমরা মিয়ানমারকে জানিয়েছি, পুরো তালিকা একত্রে নিতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা এ জায়গায় আটকে রয়েছে। এই ১ হাজার ১০০ জনকে নেয়ার বিষয়টি মেনে নিলে তাদের পাঠিয়ে দিয়ে আবারো তালিকা পাঠাব মিয়ানমারের কাছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়া, নিরাপত্তা, সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতিসংঘের যে সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে যে সমঝোতা মিয়ানমারের হয়েছিল, তা বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। এই ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে রাজি বলেও জানান তিনি।

অনেকেই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে নেপিদোর এমন চিঠির পেছনে চীনের ভূমিকা রয়েছে। কারণ কদিন আগেই ঢাকায় চায়না দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে দেশটির রাষ্ট্রদূত লি ঝিমিং বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের স্বভূমে ফেরাতে কাজ চলছে। বিষয়টি নিয়ে এতবার বলা হয়েছে, এখন আর কিছু না হওয়া পর্যন্ত বলতে চাই না। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কাজ চলছে। রাষ্ট্রদূতের সেদিন দেয়া এমন ইঙ্গিতের পরই মিয়ানমারের সামরিক সরকার এবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।

জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া সংক্রান্ত চিঠিটি মিয়ানমার সামরিক সরকারের একটি ‘চাল’। তারা রোহিঙ্গা সমাধানে খুব একটা সিরিয়াস নয়। পাশাপাশি তারা চায় না, বিষয়টির সমাধান হোক। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকার খুব চাপে আছে। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব নাজুক। এখন রোহিঙ্গা ফেরানোর বিষয় নিয়ে ঢাকাকে একটি চিঠি দিয়ে সেই ‘চাপ’ সরাতে চাইছে। চায়নার রাষ্ট্রদূতের রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ফেরাতে চায়না প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। চীনা রাষ্ট্রদূত বেশি কথা বলেন উল্লেখ করে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তার এত কথা বলার দরকার কী? আর যেসব কথা বলেন সেগুলো শোভনীয় নয়। কূটনৈতিক শিষ্টাচার রেখে তার কথা বলা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মিয়ানমারে নির্বাচন, সামরিক অভ্যুত্থান এবং করোনার কারণে বহুদিন রোহিঙ্গাফেরত প্রক্রিয়া পুরো থমকে ছিল। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুদেশের টেকনিক্যাল কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে আবারো আলোচনা শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন দেশটির ইমিগ্রেশন ও পপুলেশন মন্ত্রণালয়ের উপমহাপরিচালক ইয়ে তুন ও। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকে দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। তাছাড়া উভয়পক্ষ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পূর্ববর্তী আবাস নিশ্চিতে দেরির কারণ খুঁজে বের করতে কারিগরি পর্যায়ের এই আলোচনায় নিজেদের সদিচ্ছার কথা জানায়। বৈঠকে কারিগরি জটিলতা ও তথ্যের ঘাটতির কথা তুলে ধরে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল অনিষ্পন্ন ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ফেরাতে মিয়ানমারের উদ্যোগের প্রতি বাংলাদেশের সাড়া দেয়া উচিত। কারণ সমস্যা তো ওরাই তৈরি করেছে। চীন এখানে মধ্যস্ততা করতে চায়। চীন জড়িত হওয়ায় মিয়ানমারের উদ্যোগকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন এই অধ্যাপক। চিঠি দেয়ার বিষয়টিকে নাটকীয় অগ্রগতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সত্যি সত্যি রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত। তবু মিয়ানমারের এই উদ্যোগকে এড়িয়ে না গিয়ে ইতিবাচকভাবে দেখুক বাংলাদেশ।

উল্লেখ্য, রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হলে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি আজো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App