×

সারাদেশ

দুই বছর পর কুষ্টিয়ায় শুরু হচ্ছে লালন স্মরণোৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২২, ১১:২৬ এএম

দুই বছর পর কুষ্টিয়ায় শুরু হচ্ছে লালন স্মরণোৎসব

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত বাউল সম্রাট লালন শাহ'র আখড়াবাড়ি।

করোনা পরিস্থিতির কারণে গেল দুই বছর বিরতির পর কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব। চলবে ১৭ মার্চ পর্যন্ত। বাউল সম্রাট লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিবছর কালিগঙ্গা নদীর তীরে ভরা পূর্ণিমার তিথিতে সাধু ও ভক্তদের নিয়ে সাধুসঙ্গে মিলিত হতো। সেই অনুসারে লালনের আখড়াবাড়িতে প্রায় দুইশ বছর ধরে দোলপূর্ণিমায় এই স্মরণোৎসব পালিত হয়ে আসছে।

বছরে দুইবার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে স্মরণোৎসব পালন করা হয়। এর মধ্যে একবার পালিত হয় চৈত্রের এই দোলপূর্ণিমা রাতে এবং অপরবার ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস (পহেলা কার্তিক) উপলক্ষে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় লালন একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত স্মরণোৎসবে দেশ-বিদেশের সাধু, ভক্ত ও অনুসারীদের মিলনমেলা বসে। যা 'সাধুর হাট' হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। তারা আখড়াবাড়ি চত্ত্বরের বিশাল জায়গাজুড়ে খণ্ড খণ্ডভাবে আস্তানা গেঁড়ে একতারা থেকে শুরু করে নানা বাদ্যযন্ত্রের তালে সুরে সুরে লালনের অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার বাণী পরিবেশন করেন।

এ ছাড়া আখড়াবাড়ির মূলমঞ্চে আলোচনা অনুষ্ঠানের পর রাতভর চলে লালন সংগীত পরিবেশনা। অন্যদিকে স্মরণোৎসবকে ঘিরে মৃতপ্রায় কালিগঙ্গা নদীর কোল ঘেঁষে বসে বিভিন্ন পসরা সাজানো গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলা। কিন্তু সারাদেশে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত দুই বছরে চারটি স্মরণোৎসব বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধু, ভক্তদের মন খারাপের পাশাপাশি বিপাকে পড়েন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে টানা দুই বছর ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র আখড়াবাড়িতে লালন স্মরণোৎসব ও লালন তিরোধান দিবসের কোনো আয়োজন ছিল না।

এ বছর করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় পুনরায় স্মরণোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। দুই বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আখড়াবাড়ি স্বরূপে ফেরায় লালনের ভক্ত, অনুসারী বাউল ফকিররা এখন বেজায় খুশি। একই সঙ্গে খুশির প্রকাশ ঘটিয়েছেন লালন মাজার সংলগ্ন ব্যবসায়ীরাও। সবশেষ ২০২০ সালের দোলপূর্ণিমায় এখানে লালন স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

এবারের এই স্মরণোৎসবের সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছেন আয়োজকরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু, ভক্ত ও অনুসারীরা ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়াবাড়িতে এসে সমবেত হয়েছেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আবার উৎসবে যোগ দিতে পেরে সবার মাঝেই অন্য রকম আমেজ বিরাজ করছে।

স্মরণোৎসব উপলক্ষে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র এই অমর বাণীকে ধারণ করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনদিনের লালন স্মরণোৎসব উদ্বোধন করা হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন, এনডিসি।

বুধবার (১৬ মার্চ) দ্বিতীয় দিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) শেষ দিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, এমপি। তিনদিনের অনুষ্ঠানেই সভাপতিত্ব করবেন লালন একাডেমির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল ইসলাম।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াবাড়িই ছিল বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ'র প্রধান অবস্থান। এখানেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক তিনি দেহত্যাগ করেন। দেহত্যাগের রাতেও তিনি ভক্তদের নিয়ে আসর বসিয়েছিলেন। ভোরের দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ছাড়েন। লালন ফকিরের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর সেই আবাসস্থল কুঁড়ে ঘরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এখানে লালনের সমাধিস্থলকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৬২ সালে তাঁর সমাধিসৌধ নির্মিত হয়। পরবর্তীতে এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে লালন একাডেমি।

সাধু, ভক্ত ও অনুসারীদের মতে, তরুণ বয়সে রোগাক্রান্ত ও অচেতন অবস্থায় লালনকে ছেঁউড়িয়া গ্রামের কালিগঙ্গার পূর্বপাশের তীরে পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় মলম কারিকর ও তার স্ত্রী মতিজান। পরে অন্যদের সহযোগিতায় সেখান থেকে উদ্ধার করে মলম কারিকরের বাড়িতে এনে অসুস্থ লালনকে সেবাযত্ন করে সুস্থ করে তোলা হয়। এরপর মলম কারিকর নিজেও লালন সাঁইয়ের অনুসারী হয়ে ওঠেন।

সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষালাভের পর মলম কারিকর তার ভূসম্পত্তির একটি অংশ লালনকে লিখে দেন। একই সঙ্গে মলম কারিকরের অনুরোধ ও গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নির্দেশক্রমে লালন এই ছেঁউড়িয়া গ্রামে নির্মিত কুঁড়ে ঘরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। যা আজ ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি নামেই দেশে-বিদেশে পরিচিত।

ফকির লালন সাঁই তার জীবদ্দশায় এক বিধবা নারীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এখানে। তিনি পরে লালনের স্ত্রী রূপে এবং বিশাখা নামে পরিচিতি পান। লালন ফকির প্রতিবছর শীতকালে মহোৎসব করতেন। সেই উৎসবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্ত, অনুসারী, সাধু বাউল ফকিররা অংশ নিতেন। উৎসবকে ঘিরে সেখানে বাউল গানের আসর বসতো এবং লালন ও তার স্ত্রী পরিচয়ধারী বিশাখাও সেই আসরে অংশ নিতেন। সব গান মূলত লালন নিজেই রচনা ও সুর করতেন। যা পরে তাঁর ভক্ত ও অনুসারীরা রপ্ত করতেন। ফকির লালন সাঁইয়ের জন্ম সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী সঠিক সময়কাল শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় তিনি প্রকৃত অর্থে কত বছর বেঁচে ছিলেন তা নির্ণয় করা যায়নি। তবে লালন একজন দীর্ঘায়ু ব্যক্তি ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে তাঁর ভক্তদের ধারণা।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত বাউল সম্রাট লালন শাহ'র আখড়াবাড়ি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App