×

জাতীয়

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি মনিটরিংয়ের দুর্বলতায়!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২২, ০৮:২২ এএম

নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সেবনে বিভিন্ন সময় দেশে শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকে ‘ফ্ল্যামোডল’ নামের এক প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ৭৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়। ফ্ল্যামোডল সিরাপে ডাইইথাইলিন গ্লাইকল পাওয়া গিয়েছিল, যা শিল্প কারখানায় রাসায়নিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ওই ঘটনায় অ্যাডফ্লেম কোম্পানির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় হয় ২০১৪ সালে। এতে তিনজনকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়। ২০১৫ সালে বিসিআই ফার্মা নামে আরেক কোম্পানির পরিচালকসহ ছয়জনকে একই অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। রিড ফার্মা নামে এক ওষুধ প্রস্তুতকারীর তৈরি ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে সারাদেশে ২৮ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ এনে ২০০৯ সালে আদালতে মামলা করেছিল ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু তদন্তে গাফিলতির কথা বলে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ওই কোম্পানির মালিকসহ পাঁচজনকে আদালত বেকসুর খালাস দেয়।

একের পর এক এমন ঘটনা ঘটেই চলছে। ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বিপুলসংখ্যক নকল, ভেজাল ওষুধ উদ্ধার, জেল-জরিমানা করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। এর প্রমাণ সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঘটে যাওয়া ঘটনা। গত ১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে নাপা সিরাপ খেয়ে ইয়াছিন খান (৭) ও মুরসালিন খান (৫) নামের দুই শিশু মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এই দুই শিশুর মা লিমা বেগম জানান, নাপা খাওয়ার পর তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছে।

এ ঘটনার পর সারাদেশে নাপা সিরাপ বিক্রি বন্ধ রাখা, পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি পরিদর্শন করে বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালসের প্যারাসিটামল ১২০ মিলিগ্রাম ও ৫ মিলিগ্রাম সিরাপটি (ব্যাচ নং ৩২১১৩১২১, উৎপাদন তারিখ ১২/২০২১, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ১১/২০২৩) সরিয়ে নেয়া ও ওষুধটি পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে পরীক্ষার প্রতিবেদন ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর জন্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এই ঘটনায় কয়েকটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল রবিবার এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যে ফার্মেসি থেকে ওষুধ নেয়া হয়েছিল, সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া সিরাপগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যা যা করা প্রয়োজন, তা করছে। অপেক্ষা করছি রিপোর্ট কী আসে। তাতে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়, আশুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশুগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে পুলিশ। শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জেলার সিভিল সার্জন ডা. মুহাম্মদ একরাম উল্লাহ দুটি তদন্ত কমিটি করে ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন ভোরের কাগজকে জানান, ঘটনা তদন্তে অধিদপ্তর থেকে দুটি টিম করা হয়েছে। একটি দল বেক্সিমকোর কারখানা এবং অপর টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেবে। দুই টিমই গতকাল কাজ শুরু করেছে। আজ বা আগামীকাল রিপোর্ট পাবার আশা করছে অধিদপ্তর।

নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনবলসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের ঘাটতি আছে এ কথা ঠিক। তবে আমাদের স্বদিচ্ছার অভাব নেই। আমাদের শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করছি। আর নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুত ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না এই কথা সঠিক নয়। আইনের ধারা অনুযায়ীই জেল-জরিমানা করা হয়।

ভোরের কাগজের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জের প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, রবিবার দুপুরে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল অর্থাৎ দুর্গাপুর গ্রামে গিয়ে দুই শিশুর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. আকিব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, শিশুদের স্বজনরা জানিয়েছে, ওষুধ খাওয়ানোর পরই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ওষুধটিতে কী এমন উপাদান ছিল, যেটি খাওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে রিঅ্যাকশন করল। এটি আসলে রহস্যজনক বিষয়। এই রহস্য উদ্ঘাটনে সময় লাগবে। যে সিরাপটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেই বোতলটি থেকে সিরাপের নমুনা এবং একই ওষুধের অন্যান্য ব্যাচের ওষুধ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়া শিশু দুটির ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। তাদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ফরেনসিক তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। যে দোকানটি থেকে সিরাপটি কেনা হয়েছিল সেটি পুলিশ সিলগালা করেছে।

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মুখপাত্র রাব্বুর রেজার বক্তব্য পেতে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি। তবে এ বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নাপা সিরাপের যে ব্যাচটি নিয়ে কথা উঠেছে তার সব ডাটা যাচাই করে তারা দেখেছেন- যে মান তারা অনুসরণ করেন তার কোনো ব্যতিক্রম সেখানে হয়নি। এই ব্যাচের সিরাপ থেকে বিপদের কোনো আশঙ্কা থাকার কথাই নয়। ডিসেম্বর মাসে তৈরি ব্যাচটির ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ বোতল বিক্রি হয়েছে কিন্তু কোনো অভিযোগ আসেনি। যে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা হয়েছে সেখানে বেক্সিমকো কোনো ওষুধ কখনই বিক্রি করেনি। তিনি দাবি করেন, ওই দোকানের কোনো লাইসেন্স নেই।

বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা, স্কয়ার, রেনেটার মতো বড় বড় কোম্পানির ওষুধের মান এমন হতে পারে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বড় বড় কোম্পানির ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই তারা ওষুধ তৈরি করে। ব্যবহৃত ওষুধটি নকল অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ হতে পারে বলেও তারা মনে করছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ঔষধ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, ২০০৯ সালে প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে সারাদেশে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় ওষুধ কোম্পানিগুলো পরিদর্শন করে কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে কমিটি করা হয়েছিল আমি সেই কমিটির প্রধান ছিলাম। তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কারখানা পরিদর্শন করেছি। সেই সময় দেখেছি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মান বজায় রেখেই ওষুধ উৎপাদন করে। কিন্তু ওই সময় কুটিরশিল্পের মতো বেশ কিছু ওষুধ তৈরি কারখানার সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম। যেগুলোর কোনো লাইসেন্স ছিল না, যারা নকল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে। ভেজাল ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান সারা বছর না হলেও এসব কুটিরশিল্পের মতো গড়ে ওঠা কারখানাগুলোতে সারা বছরই নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। যার খুব কম সংখ্যকই ধরা পড়ছে। ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আসছে। তারা যদি এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে না পারে তাহলে পুলিশ, র‌্যাব বা সেনাবাহিনীকে এই দায়িত্ব দেয়া হোক। মানুষের জীবন এভাবে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App