×

জাতীয়

গণফোরামে ঘরের বিবাদ কেন মারামারিতে গড়াল!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২২, ০৭:৫২ এএম

গণফোরামে ঘরের বিবাদ কেন মারামারিতে গড়াল!

ফাইল ছবি

গৃহবিবাদ থেকে বিভক্তি যেন পিছু ছাড়ছে না গণফোরামের। এই ভাঙন, ফের মিলনের সুর; তবুও অস্বস্তি জমে জমে বরফ হচ্ছে ছোট এই দলটিতে। সেই বরফই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে সামনে এলো গতকাল শনিবার। দলটির বিবাদমান দুপক্ষ লিপ্ত হলো সংঘাতে। একাংশের ক্ষুব্ধ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হলেন আরেক অংশের শীর্ষ নেতা সাংসদ মোকাব্বির খান। এই সংঘাতের নেপথ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেনের রহস্যময় নির্লিপ্ততার সুযোগে দিনে দিনে বাড়তে থাকা পদ-পদবির লড়াই- যার সূচনা হয়েছিল বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর। সব মিলিয়ে ‘গণফোরাম’ তাহলে কার? এমন প্রশ্ন যখন সামনে তখনই দলটির এক অংশের পক্ষ থেকে বিশেষ কাউন্সিলে নতুন সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় ড. কামাল হোসেনের নাম।

তবে দলের একাধিক সূত্র বলছে, এই ঘোষণাই শেষ নয়- সব পক্ষের সম্মতি ছাড়া কাউন্সিল করা এবং পুরনো দাবি দাওয়া মেনে না নিয়েই কমিটি গঠনের ফলশ্রুতি সুখকর হবে না। চলমান পরিস্থিতিতে ড. কামাল হোসেনকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। সিদ্ধান্তে ভুল হলেই পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে।

জানতে চাইলে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল হয়ে গেছে। সেখানে ড. কামাল হোসেন শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠিয়েছিলেন, তাহলে আবার কিসের কাউন্সিল? এই কাউন্সিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও দলীয় গঠনতন্ত্র পরিপন্থি দাবি করে তিনি বলেন, ড. কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে। তার নাম ভাঙিয়ে মোকাব্বির খান গত কয়েক মাস ধরে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন।

আমরা সাংগঠনিকভাবে এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকব। একাংশের শীর্ষ নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ড. কামাল হোসেনকে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কী পদক্ষেপ নেবেন সেটা তো পরের বিষয়। গতকাল শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশেষ কাউন্সিলের আয়োজন করে ড. কামাল ও মোকাব্বির খান গ্রুপ। কাউন্সিলে ড. কামালকে ফোরামের নতুন সভাপতি হিসেবে নাম প্রস্তাব করার পর উপস্থিত ফোরামের সদস্যরা সে প্রস্তাবে সমর্থন জানান। গণফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতির নাম ঘোষণার পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির অন্য সদস্যদের তালিকা নির্ধারণে ২০ সদস্যের একটি সাবজেক্ট কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি আলোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাছাইয়ে কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আ ও ম শফিক উল্লাহ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তাব পাঠ করেন। কাউন্সিলে হামলা : ড. কামাল হোসেন অংশের গণফোরাম কাউন্সিলের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় অন্য অংশের নেতাকর্মীরা প্রেস ক্লাবের ভেতরে ঢুকে কাউন্সিলে হামলা করেন। গতকাল সকাল ১০টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের হলরুমে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কাউন্সিলে আসা নেতাকর্মীদের ওপর লাঠি হাতে অতর্কিত হামলা চালানো হয়। ভেঙে ফেলা হয় কাউন্সিলের সব চেয়ার-টেবিল। তবে ঘটনার কিছু পর পুলিশ এসে এক পক্ষকে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে বের করে দেয়। হামলাকারীরা মোকাব্বির খানকেও ধাওয়া করে। তাকে রক্ষার জন্য যারা এগিয়ে আসেন তাদেরও পেটানো হয়। এ সময় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন চলছিল।

ঘটনার পর মোকাব্বির খান অভিযোগ করে সাংবাদিকদের বলেন, গণফোরামের অপর অংশের সভাপতি মোস্তফা মহসিন মন্টুর ইন্ধনে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাউন্সিলের আয়োজন করেছি। এটা পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি। কিন্তু কিছু দুষ্কৃৃতিকারী কাউন্সিলে হামলা করে আমাকেসহ সংগঠকদের মধ্যে ২০ জনকে আহত করা হয়েছে। গণফোরাম থেকে বহিষ্কৃতরা এই হামলা চালিয়েছেন।

এদিকে মোস্তফা মহসিন মন্টু গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আজ আমরা একটি মানববন্ধন ডেকেছিলাম। সেখানে মোকাব্বিরের লোকেরা হামলা করে কয়েকজনকে আহত করেছে। এরপর মহসিন রশীদের নেতৃত্বে আমাদের লোকেরা তাদের কাউন্সিল স্থলে গিয়ে জানতে চায়, তারা আমাদের মানববন্ধনে কেন হামলা করেছে। তখন কিছু একটা হয়ে থাকতে পারে। তবে আমি সেখানে ছিলাম না।

গণফোরামের উত্থান-পতনের নেপথ্যে ঐক্যফ্রন্ট! : ১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট যাত্রা শুরু করে ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম। দীর্ঘ ২৯ বছরে মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে কখনোই শক্তিশালী অবস্থানে ছিল না দলটি। তবে সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়েও নিজেরা ছিল ঐক্যবদ্ধ। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ ৫টি রাজনৈতিক দল ও সুপরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন জোটের শীর্ষ নেতা হওয়ার পরই দলটির উত্থান ঘটে। এরপর নির্বাচনে এই জোটের ভরাডুবি এবং দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের

শপথ নেয়াকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়, যা প্রকাশ্য রূপ নেয় ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আহ্বান করা একটি বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের শেষ দিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপর হয়ে ওঠেন গণফোরামের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। কেউ এর পক্ষে আবার কেউ বিপক্ষে অবস্থান নেন। কট্টরপন্থিরা বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্য না গড়তে চেষ্টা করেন। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত উদারমনা নেতারা বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য গড়ার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। এর বাইরে বিশেষ কাউন্সিলে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে জাতীয় সংসদে শপথ নেয়ার পরও মোকাব্বির খানের উপস্থিতি নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন অনেকে।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিককে বহিষ্কার করা হয়। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দলের একটি বৃহৎ অংশ। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন অনেক সক্রিয় নেতা। কাউন্সিল শেষে নতুন কমিটিতে নির্বাচনের আগে দলে যোগ দেয়া ড. রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক এবং অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে নির্বাহী সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়। এতে দলের নতুন আরেকটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ক্ষুব্ধ নেতারা রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে থাকেন। বিভক্ত উদারমনা একটি অংশের সঙ্গে কট্টরপন্থি নেতারা যোগসাজশ করে আরেকটি পোক্ত বলয় তৈরির উদ্যোগ নেন। শুরু হয় দুটি অংশের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা।

দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা মনে করেন, মূলত সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়াকে কোণঠাসা করার জন্য এবং তাকে নাজেহাল করতেই শুরু থেকে ষড়যন্ত্র করা হয়। রেজা কিবরিয়ার গ্রহণযোগ্যতা আর পরিচিতি নিয়ে দলের একটি অংশে দেখা দেয় শঙ্কা।

কোন্দলের শুরু যেভাবে : ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দুই অংশের বিভক্তি থেকেই দলটিতে শুরু হয় কোন্দল। এ নিয়ে বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে। বিক্ষুব্ধরা অভিযোগ করেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা হচ্ছে না। তাই দলকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে এই সভাকে অগঠনতান্ত্রিক বলে দাবি করেন গণফোরাম কেন্দ্রীয় নেতারা।

দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা কমাতে ড. কামাল হোসেন শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে গঠন করেন ৭০ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি। এ কমিটিতেও ড. কামাল হোসেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হন ড. রেজা কিবরিয়া। এছাড়া সবাইকে সদস্য করা হয়। সঙ্গত, কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতারা।

ওই সময় মোস্তফা মহসিন মন্টুকে বাদ দিয়ে ড. রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার পর গণফোরাম কার্যত দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর দুই অংশের মধ্যে বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার ও নেতৃত্বের প্রশ্নে প্রায় দেড় বছর ধরে চলতে থাকা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গণফোরাম ছেড়ে দেন ড. রেজা কিবরিয়া। রেজা কিবরিয়া গণফোরাম থেকে সরে দাঁড়ালে সেই অংশের নেতৃত্বে উঠে আসেন মোকাব্বির খান। উভয় অংশই ড. কামালকে নিজেদের নেতা হিসেবে মেনে আসছেন।

২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বর্ধিত সভা ডাকে গণফোরামের একাংশ। এই সভাকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। বেরিয়ে যাওয়া অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ তিন জন নেতা। এর মধ্যেই মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামের অংশটি গত বছরের ৩ ডিসেম্বর কাউন্সিল করে। সেখানে মন্টুকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট সুব্রতকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি ঘোষণা হয়। গণফোরাম নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হওয়ায় নবনির্বাচিত কমিটির বিষয়টি তারা চিঠি দিয়ে জানায় কমিশনকে। এ সময় দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে উপস্থিত না থাকলেও একটি লিখিত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান তিনি।

চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই এই কমিটির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই জানিয়ে ড. কামাল চিঠি দিলে গণফোরামের বিভক্তি নিয়ে নতুন করে জটিলতা দেখা দেয়। এরই মধ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে মোকাব্বির খানের অনুসারী অংশ ১২ মার্চ কাউন্সিল ঘোষণা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার ড. কামাল হোসেনকে আইনি নোটিস পাঠানো হয় মোস্তফা মহসিন মন্টু ও এডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর পক্ষ থেকে। পরে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে ও সুব্রত চৌধুরী নেতৃত্বাধীন কাউন্সিলকে অবৈধ বলে গত শুক্রবার পাল্টা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App