×

আন্তর্জাতিক

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা আসলে কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২২, ০৯:১০ এএম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা আসলে কী

বৃহস্পতিবার তুরস্কের মধ্যস্থতায় আনাতোলিয়ায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বৈঠক হয়। ছবি: ভোরের কাগজ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১৫তম দিন বৃহস্পতিবার তুরস্কের আনাতোলিয়া শহরে বৈঠকে বসেছেন যুদ্ধরত দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বৈঠক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না এলেও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসলু এ বৈঠককে ‘গুরুত্বপূর্ণ সূচনা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এক সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, মাত্র একটি বৈঠক থেকে অলৌকিক কিছু আশা করা উচিৎ নয়। খবর বিবিসির।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর এবারই প্রথম দুটো দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এ যুদ্ধে তুরস্ক নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছে। পক্ষান্তরে বিশ্লেষকরা বলেছেন, তুরস্ক একই সঙ্গে ন্যাটোর সদস্য এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকায় যুদ্ধকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

ঢাকায় সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির বলছেন যেহেতু ওয়াশিংটন, মস্কো ও কিয়েভ- সবার সঙ্গেই তুরস্কের সম্পর্ক ভালো। তাই মধ্যস্থতার সুযোগ কেবল তুরস্কেরই আছে এবং এ সুযোগ ইসরায়েলের চেয়েও বেশি কার্যকর হবে।

ইউক্রেনের কিয়েভভিত্তিক ইস্ট ইউরোপীয় ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের চেয়ারপারসন ড. মৃদুলা ঘোষ বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন দুুই দেশের সঙ্গে তুরস্কের একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে। আবার ন্যাটোর সদস্য হলেও দেশটি রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ মিত্র। বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, আমরা মনে হয় এ কারণেই ভ্লাদিমির পুতিন চাইছেন যে কাউকে যদি মধ্যস্থতা করতে হয় সেটা তুরস্কই করুক।

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ

যুদ্ধ শুরুর পর পরই রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। যার ফলে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

গত ৬ মার্চ পুতিনের সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ফোনে কথা বলেন। এক ঘণ্টার ফোনালাপে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তবে একই সাথে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহার এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতিও তিনি সমর্থন জানান। তুরস্কের সরকারপন্থী পত্রিকাগুলো তখন থেকেই তুরস্কের পরিকল্পনাকে ‘পিস টেবিল’ বা ‘হোপ ফর পিস’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করে।

মূলত এখান থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা রাখার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন খবর আসতে থাকে সেখানকার পত্রপত্রিকায়। এসব খবরে একটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়, ‘তুরস্ক উভয় পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে’। অর্থাৎ নিরপেক্ষ একটি ভূমিকার বিষয়ে দেশটির নেতৃত্ব সচেষ্ট। অবশ্য ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার আগে থেকেই এ সংকট নিরসনের মধ্যস্থতার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এরদোগান। বিষয়টি নিয়ে ড. মৃদুলা ঘোষ বলেন, তুরস্ক এবং ইসরায়েলের দিক থেকে তৎপরতা দেখা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে তুরস্কে।

মৃদুলা ঘোষ আরও বলেন, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সক্ষমতার কথা বিবেচনায় নিলে দুই দেশকে আলোচনায় আনার সুযোগ শুধু তুরস্কেরই আছে। পশ্চিমারাও তাতে বাধা দেবে না। কারণ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং ওয়াশিংটনের মিত্র।

হুমায়ুন কবির বলেন, তুরস্কের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত ইতিবাচক। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব, মস্কো ও কিয়েভ- সব পক্ষের কাছেই দেশটির গ্রহণযোগ্যতা আছে।

তুরস্কের সরকারপন্থী সাবাহ পত্রিকার কলামিস্ট ওকান মুদেরিসগুলো গত ৩ মার্চ তার লেখায় এরদোগানের সম্ভাব্য মধ্যস্থতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, আঙ্কারা যে কৌশল গ্রহণ করেছে সেটি হলো ‘সক্রিয় নিরপেক্ষতা’। অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি ও কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানে আঙ্কারা ভূমিকা রাখবে।

ঐতিহাসিক যোগসূত্র ও আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার

ড. মৃদুলা ঘোষ বলছেন ক্রিমিয়ার সঙ্গে তুরস্কের একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে। সেখানকার তাতারদের ওপর তুরস্কের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যদিও তারা সেখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।

আবার পর্দার অন্তরালে যা কিছুই হোক না কেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এরদোগান। যদিও তার দেশ ন্যাটোর সদস্য।

বিশ্লেষকরা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কেনা নিয়ে ন্যাটোর সঙ্গে বিবাদে জড়ালেও সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগর্নো-কারাবাখে রাশিয়ার উল্টোদিকেও অবস্থান নিয়েছে দেশটি।

ইউক্রেন সংকট নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছেন। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেনে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও দৃষ্টি দিয়েছে তুরস্ক। এছাড়াও রুশ পর্যটকদের জন্য তুরস্ক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি করে তুরস্ক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তুরস্কের অর্থনীতি- সেটিও বিবেচনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। আর এসব কারণে হয়তো মধ্যস্থতার উদ্যোগকেই জরুরি মনে করেন তিনি।

পুতিন-জেলেনস্কি বৈঠকই কী টার্গেট

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতোমধ্যেই বলেছেন, তিনি সরাসরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। এদিকে বৃহস্পতিবার তুরস্কের আনাতোলিয়া শহরে বৈঠকের পর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, এ ধরনের বৈঠক নির্ভর করবে আলোচকদের প্রস্তুতির ওপর।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ইউক্রেন সংকটের সমাধানে তার দেশ ‘সিরিয়াস আলোচনা’ চায়।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে এ শান্তি আলোচনার পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসলু এ বৈঠককে ‘গুরুত্বপূর্ণ সূচনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও আমি বলবো একটি ভালো বৈঠক হয়েছে। আমরা মানবিক করিডোর খোলা রাখার ওপর জোর দিয়েছিলাম।

যদিও এ বৈঠকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বৈঠকের পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বলেন, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেসব দাবি তুলে ধরেছেন সেগুলো মানা হলে সেটা হবে তাদের কাছে আত্মসমর্পণের শামিল।

বিষয়টি নিয়ে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেছেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন এটি চায়। রাশিয়া সেটি বাতিল করে দেয়নি। বরং আমি মনে করি তুরস্কের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত এটিও হতে পারে। সে সুযোগ আছে।

সব মিলিয়ে একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি আর রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে আলোচনায় বসানোর সুযোগ তুরস্কের আছে এবং সেটি করতে পারলে বিশ্ব রাজনীতিতে দেশটির অবস্থান যে আরও সংহত হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এ বিষয়ে ইসরায়েলের দিক থেকে কিছুটা তৎপরতা দেখা গেলেও সেটি খুব বেশি অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন ড. মৃদুলা ঘোষ ও হুমায়ুন কবির।

হুমায়ুন কবির বলেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে ইসরায়েলের সেই গ্রহণযোগ্যতা নেই যা তুরস্কের আছে।

মৃদুলা ঘোষ বলছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইহুদি বলে হয়তো ইসরায়েল আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের সংকটে ভূমিকা রাখার প্রভাব-প্রতিপত্তি তুরস্কেরই বেশি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App