×

জাতীয়

বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুতে বালির নামে ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২২, ০৩:৩৮ পিএম

কোটি টাকা খরচে গুলশানে খোলা হয় আল-তাকদীরের নামে ভুয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সরবরাহকারীদের বিশ্বাস অর্জনে আপ্যায়নে খাওয়ানো হত শতাধিক পদের খাবার।

এলসি সুবিধা পেতে ১০ কোটি টাকা কাবিনে দ্বিতীয় বিয়ে আলমগীরের।

ভুয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতারক চক্রের তিনজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- প্রতারক চক্রের মূলহোতা মো. আলমগীর হোসাইন (৪৮) এবং দুজন সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম (৪৬) ও মো. ইমরান হোসাইন (৪৪)।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগের সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু প্রকল্পে ৩০০ কোটি সিএফটি বালি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে বলে প্রচারণা চালায় চক্রটি। বিভিন্ন বালি সরবরাহকারীর সঙ্গে ভুয়া চুক্তি করে তারা। চুক্তি মোতাবেক কমিশন হিসেবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে ৩৫-৪০ কোটি টাকা নিয়ে নেয় চক্রটি। পরে এই টাকা আত্মসাৎ করে অফিস বন্ধ করে পালিয়ে যায় আলমগীরসহ বাকিরা।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকার ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার তৈরি করে মাল সরবরাহকারীদের আকৃষ্ট করতো চক্রটি। সরবরাহকারীরা যাতে সন্দেহ না করে তাই রাজধানীর গুলশানে কোটি টাকা খরচ করে আল-তাকদীরের নামে ভুয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খোলেন আলমগীর হোসাইন। মাল সরবরাহকারীরা অফিসে কাজের চুক্তি করতে আসলে গুলশানের নামিদামি রেস্টুরেন্টে থেকে শতাধিক খাবারের পদ এনে তাদের আপ্যায়ন করা হতো। এভাবেই সরবরাহকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে প্রজেক্টের বালির অর্ডার দিতো চক্রটি।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, গত মঙ্গলবার (৮ মার্চ) রাজধানীর গুলশান থানায় এ সংক্রান্ত একটি মামলা হলে ছায়াতদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তের এক পর্যায়ে গতকাল বুধবার (৯ মার্চ) রাতে রাজধানীর খিলগাঁও ও গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের হোতা আলমগীরসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬ টি মোবাইল, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডারের কপি, সাপ্লায়ারদের সঙ্গে ষ্ট্যাম্প চুক্তিপত্রের কপি ও একটি ১০ কোটি টাকা কাবিনের ফটোকপি উদ্ধার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রতারক আলমগীর হোসাইন গুলশানে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে একটি অফিসে নেয়। সেখানে আল তাকদীর ইন্টারন্যাশনাল নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে। পরে আট হাজার কোটি টাকার ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছেন বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলো সে। সর্বশেষ গত বছর সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে ব্রিজ প্রজেক্টের ৩০০ কোটি সিএফটি বালি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে বলে প্রচারণা চালায়।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, তার তাকদীর টিভি নামে নিজস্ব অনলাইন টিভিতে ব্যাপকভাবে এ প্রচারণা চালায়। এসব প্রচারণা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৩০০ জন আগ্রহী বালি সরবরাহকারী তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আগ্রহীদের এক সিএফটি বালিতে ১০ টাকা লাভ হবে এই যুক্তি দেখিয়ে সরবরাহকারীদের সঙ্গে ভুয়া চুক্তি করে কমিশন হিসেবে ৩৫-৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

ইমাম হোসেন আরও বলেন, আলমগীর হোসাইন নিজেকে অতি বড় মাপের ঠিকাদার প্রমাণের জন্য বড় সরবরাহকারীদের নিয়ে বিভিন্ন রিসোর্টে কয়েকবার বড় ধরনের পার্টির আয়োজন করে।

প্রজেক্ট এলাকায় সরবরাহকারীদের নিয়ে ‘প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে ব্রিজের বালি সরবরাহের নিজস্ব ডাম্পিং পয়েন্টের শুভ উদ্বোধন’ লেখা ব্যানারে যমুনা সেতুর পাশে লালগালিচা বিছিয়ে ধুমধাম করে কাজ উদ্বোধন করে। যার অনেক ছবি ও ভিডিও চিত্র বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে রয়েছে। এ অনুষ্ঠানে নামীদামী অনেক ব্যক্তিদের হাস্যজ্জল উপস্থিত দেখা যায়। তার এ ধরনের কার্যকলাপ দেখে বিশেষ করে টাঙ্গাইল এলাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার অনেক সরবরাহকারী কাজ পাওয়ার আশায় প্রতারক আলমগীরের অফিসে এসে চুক্তি করে প্রতারিত হয়েছে। পরে সবার টাকা আত্মসাৎ করে অফিস ও মোবাইল ফোন বন্ধ করে উধাও হয়ে যায় আলমগীর। পরে অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল রাতে আলমগীরসহ এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত চক্রের মূলহোতা আলমগীর জানায়, এই কাজ চলার সময়ের মধ্যে লেনদেনের সূত্র ধরে ইস্টার্ণ ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা সালমা সুলতানা সুইটি নামে এক নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে ওই নারীর সঙ্গে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। ওই নারী ব্যাংক কর্মকর্তা নিজে গ্রান্টার হয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকার এলসি, এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্যাশ করে দেবে বলে আলমগীরকে আশ্বস্ত করে। আশ্বাস পেয়ে আলমগীর তার প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে ব্যাংকার সালমা সুলতানা সুইটিকে তার দাবি মোতাবেক ১০ কোটি টাকার কাবিন দিয়ে গত বছরের জুলাই মাসে বিয়ে করে। বিয়ের পর গুলশানের মাসিক দুই লাখ টাকায় একটি বাসা ভাড়া করে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকা শুরু করে।

চক্রের মূলহোতা আরও জানায়, এদিকে মানুষ জনকে প্রতারিত করে আত্মসাৎ করা টাকায় দ্বিতীয় স্ত্রীর চাহিদা মতো কোটি টাকার গহনা ও নগদ টাকাসহ প্রায় চার কোটি টাকা তাকে দেয় সে। পরে এলসি না হওয়ায় আলমগীর ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হয়। এক পর্যায়ে গত বছরের নভেম্বর মাসে আলমগীরকে ডিভোর্স দেয়। পরে ১০ কোটি টাকা দেনমোহরের টাকা আদায়ের জন্য তার দ্বিতীয় স্ত্রী আদালতে মামলা করেছে।

আলমগীর জানায়, আলমগীর এর আগেও নানা কৌশলে বিভিন্নভাবে মানুষজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এর আগে আলমগীর বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল নামে ট্রাভেল এজেন্সি খুলে সৌদি আরবের জাল ১৫০টি ভিসা নিয়ে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার ও প্রতারণার অভিযোগে ডজনখানেক মামলা আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App