আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২, ০৮:১৪ এএম
বিশ্ব এবার এমন একটা সময়ে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন করছে যখন শুরু হয়েছে নারী ক্রিকেটারদের বিশ্বকাপ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররাও এক বুক আশা আর প্রত্যয় নিয়ে দেশের জন্য গৌরব জিতে আনতে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন। আমাদের এই ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপ জিতবেন নাকি হারবেন, তাতে আমি চিন্তিত নই। খেলায় হারজিত থাকবে, কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করাটাই বড় অর্জন। বাংলাদেশের প্রথম খেলাটা আমি মন দিয়ে দেখেছি আর নিজেকে তৃপ্ত করেছি দেশের জন্য গৌরব ছিনিয়ে আনা যোদ্ধাদের প্রাণপণ চেষ্টা দেখে। আমি দেখেছি তাদের বলিষ্ঠ দুটি হাত, গতিশীল দুটি পা, প্রতিশ্রæতিশীল দুচোখের দৃষ্টি আর চেতনায় দৃপ্ত মনের জোর। মাঠের মাঝখানে সাজানো বাইশ গজের পিচ আর দুই দিকে শক্ত করে পোঁতা স্ট্যাম্পের বাধা ভেঙে নারী ক্রিকেটারদের অর্জনের স্বপ্ন যেন এগিয়ে যাচ্ছে আরো সামনের দিকে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছে, যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেন, বিশ্ব শিরোপা জয় একদিন সুনিশ্চিত।
প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আমি কিছু লিখি আমার নিজের অনুভূতিকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার জন্য। এ বছর জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের বিষয় হলো ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। কিন্তু এর সঙ্গে মিলিয়ে আমার লেখাটা কীভাবে সাজাব তার যথোপযুক্ত পট মিলাতে পারছিলাম না। আজ নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জয়ের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা ও দৃঢ়তা দেখে মনের অজান্তেই বলে ওঠলাম, ‘হ্যাঁ, জেন্ডার সমতা অর্জন সম্ভব এবং আমরাই পারব!’ সমালোচকরা বলতে পারেন, কীভাবে? বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা তো হেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের একজন আশা জাগানিয়া মানুষ হিসেবে আমি তাতে হতাশ নই। আজ হেরেছে বলে কাল বা পরশু জিতবে না এমন তো কোনো ভবিষ্যদ্বাণী কোথাও লেখা নেই!
জেন্ডার সমতা শব্দটি নতুন নয়। প্রচলিত সনাতনী মূল্যবোধ, বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, প্রথা, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি সংস্কার করার মধ্য দিয়ে সমাজে নারী-পুরুষের অধিকার, সম্মান, মর্যাদা প্রাপ্তিতে সমতা আনার সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। এর জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে যুগান্তকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ- আইন, সনদ, কর্মকৌশল। কিন্তু সংস্কারের গতি খুব ধীর এবং অনেকটাই উপেক্ষিত। নারী, পুরুষের সমঅধিকারের কথা শুনলে আজো প্রশ্ন ওঠে সমতার কথাই যদি বলেন তাহলে বাসে আলাদা সিট সংরক্ষিত কেন? বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ কেন? সংসদে সংরক্ষিত আসন কেন? এমনকি এও শুনতে হয়েছে খেলোয়াড় তো খেলোয়াড়ই হয়, তাহলে আলাদাভাবে নারী ফুটবলার, নারী ক্রিকেটার কেন? এই হলো আমাদের রক্ষণশীল মানসিকতা। যে সমাজে এখনো ক্রিকেটার, ফুটবলার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, বৈমানিক, ইত্যাদি বললে মানুষের চোখে সবার আগে একজন পুরুষের ছবি ভাসে সেখানে নারীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত না করলে কি আমাদের সুদৃষ্টির বিকাশ ঘটবে?
‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-এর ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সদর্পে নারী দিবসের প্রায় অর্ধশতবর্ষ হলো, কিন্তু সগৌরবে কি আমরা বলতে পারব- নারীর প্রতি নিপীড়ন, বৈষম্য আর অবিচার সমাজ থেকে দূর করতে পেরেছি? এ সমাজকে আমরা নারী ও মেয়েদের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য করতে পেরেছি? আমরা প্রায়ই বলি, দীর্ঘদিনের সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ বদলাতে সময় লাগবে, মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। সমাজ থেকে এই ধরনের অন্যায়, অনৈতিক আচরণ দূর করতে আরো কত সময় নেব আমরা? আরো কত সহ্য করতে হবে আমাদের?
সমাজ বাস্তবতায় জেন্ডার সমতা অর্জনের পথ হয়তো সুগম হবে না। চলার পথে কাঁটা থাকবে, কালো থাবার ভয় থাকবে, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া, হোঁচট খেয়ে পিছলে পড়া- অতঃপর আবার ওঠে দাঁড়ানো। এমন অবস্থায় কেউ এসে হাত ধরতে পারে আবার নাও পারে। তবে কি থমকে গিয়ে থেমে যাওয়া! না, আর নয় পেছন ফেরা। সমানে হাতছানি দিচ্ছে চেতনার অগ্নিশিখা। আপন শক্তিতে নিজেকে জয় করার এখনই সময়।
লাভলী ইয়াসমিন জেবা
লেখক ও নারী অধিকার আন্দোলনকর্মী
[email protected]