×

সারাদেশ

৫০ বছরেও মোছা যায়নি সেই কুখ্যাত খাজা নাজিমের নাম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:১৬ পিএম

৫০ বছরেও মোছা যায়নি সেই কুখ্যাত খাজা নাজিমের নাম

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পরিবর্তন করা হয়নি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম। ছবি: ভোরের কাগজ

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পরিবর্তন করা হয়নি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের আওতাধীন হলেও রেলওয়ে মন্ত্রণালয় পরিচালিত। শিক্ষাকার্যক্রম বোর্ড পরিচালিত হলেও পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের। ঈশ্বরদী পৌর এলাকার বিহারী অধ্যুষিত ফতেমোহাম্মদপুর মহল্লায় উঁচু দেয়ালে ঘেরা বিদ্যালয়টি প্রধান ফটকেই বড় সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়’। একাধিক গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের নামানুসারের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিভাগীয় রেলওয়ে অফিসে তা পাঠানোও হয়েছে। তবে ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি। এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করার দাবিতে ঈশ্বরদী উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে স্কুলের প্রধান ফটক থেকে 'নাজিম উদ্দিন' নামটি কালো কালি দিয়ে মুছে দেয়। ছাত্রলীগের এই উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও কাজের কাজ হয়নি এখনও।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুললে এর প্রবল বিরোধিতা করেন পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন। সে বছরের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' তার সেই ঘোষণায় বাঙালি ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন এক ভাষণে জিন্নাহর কথারই পুনরুক্তি করেন। তার এই বক্তব্য ছাত্রদের আন্দোলনে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়। এরপর সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সভা-সমাবেশের ডাক দেয়। প্রশাসন ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভেঙেই ছাত্রজনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলিত হতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউরসহ অনেকে নিহত হন। মূলত খাজা নাজিম উদ্দীনের নির্দেশেই পুলিশ এই হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে ধারণা করা হয়। অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলার শত্রু ঘৃণ্য সেই নাজিম উদ্দীনের নাম গত ৭০ বছর ধরে ঈশ্বরদীবাসী বয়ে বেড়াচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরদীর জিন্না কলেজের নাম পরিবর্তন করে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ঈশ্বরদীর একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হয়েছে। অথচ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণ করা সেই খাজা নাজিম উদ্দীনের নামে 'বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়' আজও বহাল তবিয়তে আছে। একাধিকবার এই স্কুলের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে জন্মেছে ক্ষোভ ও হতাশা। এবার অন্তত এই ভাষার মাসে স্কুলটি থেকে নাজিম উদ্দীনের নাম অপসারণের জোরালো দাবি তুলেছেন তারা।

'ঈশ্বরদীর ইতিহাস' বইয়ের লেখক মুক্তিযোদ্ধা কামাল আহমেদ জানান, ১৯৫২ সালে ঈশ্বরদীর অবাঙালিরা লোকো রোডে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিশালাকার রেলওয়ে রানিংরুমে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের নামে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি নাজিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠা পায়। স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে স্কুলটির বিশাল ভবনের বেশিরভাগ অংশই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করার দাবি জানানো হয়েছিল, কিন্তু এখনও নাম পরিবর্তন করা হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু বলেন, এর আগে জিন্না কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ খাজা নাজিম উদ্দীনের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির নাম এখনও রয়ে গেছে, যা ঈশ্বরদীবাসীর জন্য খুবই অসম্মানজনক।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা চান্না মন্ডল বলেন, আমরাও এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছি।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক খন্দকার আব্দুর রহমান জানান, তদন্ত কমিটির কাছে এই বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার জন্য সুপারিশমালা পাঠানো হয়েছে কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান রেখে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, এই স্কুলের নাম পাল্টানোর জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সুপারিশপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন,দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করার জন্য আমি এ এলাকার এমপি হিসেবে রেলমন্ত্রীকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App