×

জাতীয়

বদলে যাচ্ছে মাদকবিরোধী যুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:২৩ এএম

** ‘সমন্বিত অ্যাকশন প্ল্যান’ ** তথ্য শেয়ারিংয়ে ৩ অ্যাপস ** ঢাকা বিভাগে উদ্বোধন হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি **

‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৮ সালের ৪ মে দেশব্যাপী শুরু হয় মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান। চলমান এ অভিযানে অনেক কারবারি গ্রেপ্তার ও বন্দুকযুদ্ধে ৬ শতাধিক নিহত হলেও কমেনি মাদকের বিস্তার। উল্টো র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার পর ঝিমিয়ে পড়েছে অভিযান। এই সুযোগে মিয়ানমার থেকে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথের (আইস) ঢল নামতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় মাদক নিয়ন্ত্রণে ‘কমপ্রিহেন্সিভ অ্যাকশন প্ল্যান’ বা সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।

শুধু ধরপাকড় নয়, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, কাউন্সিলিং ও সচেতনতা বাড়িয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সংস্থা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ইসলামী ফাউন্ডেশন, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষ।

গত ২৯ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে মাদক নিয়ন্ত্রণে ‘কমপ্রিহেন্সিভ অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে এ পরিকল্পনার খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। ২২ ডিসেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা আমাদের ছিল। করোনা মহামারি এবং আরো কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে হয়নি। তবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিভাগে কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা বলছেন, এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে মাদকের কারবার। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকা বিভাগের কর্মশালা উদ্বোধন করবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। সেমিনারে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগের সব কয়টি জেলার ডিসি, এসপি ও সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত থাকবেন। দ্রুততম সময়ে পর্যায়ক্রমে অন্য ৭ বিভাগে এ ধরনের কর্মশালা চালু করা হবে। এরপর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেমিনার করে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হবে। এবার সারাদেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এ কাজে সহযোগিতা করবে জনপ্রতিনিধি, স্কুলের শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ সর্বস্তরের জনগণ। এজন্য বিশেষ ৩টি অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছে। একটি অ্যাপসে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা মনিটর করা হবে, আরেকটিতে পরিচয় গোপন রেখে দেয়া যাবে মাদকাসক্ত কিংবা মাদক কারবারির তথ্য, আরেকটি অ্যাপসে মাদক নিরাময়ের তথ্য মনিটর করা হবে। একটি ওয়ার্ডের নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে এই অ্যাপসে তথ্য দেয়ার সুযোগ রাখা হবে।

ডিএনসির একাধিক সূত্র জানায়, ডিএনসি মাদকের সাপ্লাই বন্ধ করা, চাহিদা রোধ ও ক্ষতি হ্রাস বা নিরাময়ের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। এই ৩টি জিনিসের সমন্বয়ে ‘সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা’ কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, প্রত্যেক ওয়ার্ডে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে জোর দেয়া হবে। প্রতি ওয়ার্ডের মেম্বার, মসজিদের ইমাম, স্কুলশিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবক, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে নিয়মিত সভা-সেমিনার করে মাদকবিরোধী সচেনতা বাড়াতে কাজ করবেন। এজন্য থাকবে আলাদা কর্মপরিকল্পনা। প্রতিটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আলাদা কমিটি তাদের প্রত্যেক ওয়ার্ডে স্কুল-কলেজে মাদকবিরোধী সেমিনার, ওয়াজ-বয়ান, ক্রিকেট-ফুটবল খেলার আয়োজন করাসহ কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করবে তার একটি বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করবে। সচেনতামূলক কাজের তৈরি অ্যাপসে ওই কর্মপরিকল্পনা বিস্তারিত দিতে হবে। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়মিত তদারকি করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিএনসি।

এরপরের বিষয়টি হচ্ছে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও কাউন্সিলিংয়ের বিষয়। কোনো গ্রামে বা এলাকায় কারা মাদকাসক্ত আছে সেটি আলাদা আরেকটি অ্যাপসে জানানো যাবে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা পরিবার পরিকল্পনার সদস্যরা ওই বাড়িতে গিয়ে মাদকাসক্তের খোঁজখবর নিয়ে কাউন্সিলিং করবেন। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক ও পরিবার পরিকল্পনার সদস্যদের মানসিক চিকিৎসার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। যেসব মাদকাসক্ত রোগীর অবস্থা বেশি নাজুক তাদের সংশ্লিষ্ট উপজেলা, প্রয়োজনে জেলায় কিংবা ঢাকায় কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। কোন ওয়ার্ডে কতজন মাদকাসক্ত রয়েছে এবং তাদের পুনর্বাসনে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটিও ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করা হবে।

সর্বশেষ কাজটি হচ্ছে অপারেশনাল। আলাদা আরেকটি অ্যাপসে দেয়া যাবে এলাকাভিত্তিক মাদক কারবারির তথ্য। ওই ওয়ার্ডের নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে ওই অ্যাপসে তথ্য দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হবে। তথ্যদাতার নাম পরিচয় গোপন রেখে মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তারে অভিযানে যাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রত্যেক জেলার মাদক কারবারি গ্রেপ্তারের বিষয়টি তদারকি করবেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)। এই ৩টি অ্যাপসের তথ্যই ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়নে, এরপর পর্যায়ক্রমে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি), বিভাগীয় কমিশনার, ডিএনসি হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবে।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী যুদ্ধ শুধু ধরপাকড়ে সীমাবদ্ধ থাকায় তেমন সফলতা আসেনি। এজন্য চাহিদা রোধ করে সাপ্লাই বন্ধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে এই মহাপরিকল্পনা হতে নেয়া হয়েছে। প্রতিটি মহল্লায় যখন মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে সবাই অবগত হবে, তখন আর মাদকের দিকে ঝুঁকবে না। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক মাদক কারবারিরাও আইনের আওতায় আসবে। তখন এমনিতেই মাদকের চালান থেমে যাবে। ডিএনসির এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটারের বিশাল সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে জলসীমান্ত রয়েছে বিশাল জায়গাজুড়ে। অনেক সীমান্ত এলাকাই অরক্ষিত। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়াকড়ির ফাঁক গলিয়ে ঠিকই নতুন নতুন রুট দিয়ে মাদক আসছে। এ অবস্থায় শুধু ধরপাকড় করে লাভ হবে না। এজন্য চাহিদা রোধ করার কোনো বিকল্প নেই।

ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের সর্বস্তরের জনগণের সমন্বয়ে শুরু করতে যাওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে মাদক নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কারণ, আমরা এই পরিকল্পনাতে মাদকের সাপ্লাই রোধ, চাহিদা কমানো ও নিরাময়সহ সব ধরনের পদক্ষেপ রেখেছি। সামগ্রিক কাজের অংশ হিসেবে আমরা প্রথমে বিভাগীয় পর্যায়ে এবং পরে পর্যায়ক্রমে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেমিনার করে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয় বা জনসাধারণের মতামত নেব। তাদের কথা শুনে যদি মনে হয় এই পরিকল্পনায় আরো কিছু যুক্ত করা দরকার সেটিও করব। সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের একটিই উদ্দেশ্যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে দেশকে, দেশের যুবসমাজকে মাদকমুক্ত করা।

মাদকবিরোধী যুদ্ধ ব্যর্থ হওয়ার কারণেই কি এই পরিকল্পনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদকবিরোধী যুদ্ধ চলমান রয়েছে। সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি অভিযান চলমান থাকবে। আগে শুধু অপারেশনাল কার্যক্রম চলত, এখন থেকে সাপ্লাই ও চাহিদা রোধের কার্যক্রমও পরিচালিত হবে। কতদিনের মধ্যে এই কার্যক্রম শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী ২ মাসের মধ্যে ৮ বিভাগে সেমিনার সম্পন্ন করা হবে। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলা-উপজেলায় সেমিনার করে সামগ্রিক কার্যক্রম শুরু করা হবে।

ডিএনসির উপপরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মো. মাঞ্জুরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে সবার দোরগোড়ায় এখন ডিজিটাল সেবা। এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে পরিকল্পনাটিতে অ্যাপসভিত্তিক তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এবার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়ন হলে মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App