×

অপরাধ

ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিরা বারবার অপরাধে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিরা বারবার অপরাধে

প্রতীকী ছবি

ফৌজদারি কার্যক্রমের দুর্বলতা যত দ্রুত সম্ভব চার্জশিট দেয়া দরকার

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে বিভিন্ন সময় অপরাধে জড়ানো দোষীরা আটক বা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। তবে দেখা যাচ্ছে নির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারকৃত অধিকাংশেরই বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ ছাড়াও আগে থেকেই এক বা একাধিক মামলা রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে কী ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তিরা বারবার অপরাধে জড়াচ্ছেন?

বিষয়টিকে উদ্বেজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন ফৌজদারি কার্যক্রমের নানা দুর্বলতা বা ত্রুটির জন্যই এমনটি হচ্ছে। তারা আরো বলছেন, এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত নয়। ফলে একজন দোষী ব্যক্তি শাস্তি ভোগের মধ্য দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ভবিষ্যতে অপরাধ করা থেকে কতটুকু বিরত থাকবে তা বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং ও মোটিভেশনাল থেরাপিরও অভাব রয়েছে। এ ছাড়াও এফআইআর এর দুর্বলতার চার্জশিটের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগেও জামিন পেয়ে আবারো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। তাই ফৌজদারি কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বিজ্ঞাননির্ভর শাস্তি ব্যবস্থা। কারাগার থেকে বের হয়ে গেলে তাকে ফলোআপে রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দিলীপ, আলামিন ও নাইমুর রহমান নামে তিন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার সদস্যদের মধ্যে দিলীপ, আলামিন ও আবু জাফর ওরফে বিপ্লব তিনটি ডাকাত দলের প্রধান। গ্রেপ্তারদের মধ্যে দিলীপ নবীনগর ও আশুলিয়া এলাকায় দিনের বেলা ডাব বিক্রি করেন। তিনি ২০ বছর ধরে ডাকাতি করছেন। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ তিনটি মামলা রয়েছে। আলামিনের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলাসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে। আবু জাফর ২০১৬ সালে আশুলিয়া এলাকায় বাসে ডাকাতির সময় দুই যাত্রীকে খুন করেন।

গত এক মাসে ঢাকা, সাভার ও টাঙ্গাইলে বাসে ঘুরে-ফিরেই এরাই ডাকাতি সংঘটিত করে। রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার জাকের সুপার মার্কেটের ছাদ থেকে ফেলে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার মো. ফিরোজ আহম্মেদ, মো. হুমায়ুন কবির বিটু, মো. নাসির উদ্দিন, মাহমুদুল হাসান রাসেল, হাজী মো. ফরিদ ভূইয়া ওরফে ছোট ফরিদ, ও মো. আলম শিকদারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১০। গ্রেপ্তার প্রধান অভিযুক্ত ফিরোজ আহম্মেদের বিরুদ্ধে চারটি ও নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানায় র‌্যাব। এ ছাড়াও গত ২৫ জানুয়ারি নাম্বার স্পুফিং বা ক্লোনিং করে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া মোবাইল ব্যাংকিং হ্যাকার চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৪ এর একটি দল।

তারা জানায়, গ্রেপ্তার নুরুজ্জামান মাতুব্বর ২০১৮ সাল থেকে প্রতারণা করে আসছে। সে গত বছর ডিজিটাল প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিল। গত তিন মাস আগে জামিনে বের হয়ে ফের প্রতারণার কাজে যোগ দেয় সে। তার নামে তিনটি ডিজিটাল প্রতারণার মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার সজিব মাতুব্বরের নামেও মাদক ও ডিজিটাল মামলা রয়েছে। দুই মাস আগেও জামিনে বের হয়ে ফের প্রতারণার কাজে যোগ দেয়। র‌্যাব ও পুলিশের এমন প্রায় অভিযানেই গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ ছাড়াও আগে থেকেই এক বা একাধিক মামলা রয়েছে দেখা যায়।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. উমর ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, কয়েকটি কারণে এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ হচ্ছে না। প্রথমত, আমাদের ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত নয়। ফলে একজন দোষী ব্যক্তি শাস্তি ভোগের মধ্য দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ভবিষ্যতে অপরাধ করা থেকে কতটুকু বিরত থাকবে তা বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং ও মোটিভেশনাল থেরাপিরও অভাব রয়েছে ব্যাপক হারে। আর কারাগার থেকে বের হয়ে গেলে অপরাধীকে ফলোআপ করার বিষয়টি একদম নেই বললেই চলে। অপরাধী বের হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরল নাকি আগের মতোই রয়ে গেল কিংবা আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল তা দেখার যেন কেউ নেই।

তিনি আরো বলেন, একজন অপরাধীকে আমরা যদি অসুস্থ বলে বিবেচনা করি তাহলে কারাভোগের সময়টিকে আমরা তার চিকিৎসার সময় বলে ধরে নিই। কিন্তু কারা-সংস্কৃতিই উল্টো আমাদের। আমরা দেখছি অনেক সময় কারাগার একজন শাস্তিভোগীকে আরো বেশি অপরাধী করে তুলছে। পর্যাপ্ত কাউন্সিলিং ও মোটিভেশনাল থেরাপির অভাবে কারাগারে অন্যান্য অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে আরো অপরাধের যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। ফলে শাস্তি ভোগ শেষে বা জামিনে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে। তাই ফৌজদারি কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক করতে হবে বলে মনে করেন ড. উমর ফারুক। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিশেষ নজরদারি দিতে হবে। বিজ্ঞাননির্ভর শাস্তি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারাগার থেকে বের হয়ে গেলে তাকে ফলোআপ করতে হবে।

মানবাধিকারকর্মী ও এডভোকেট এলিনা খান এ প্রতিবেদককে বলেন, জামিন পাওয়া অভিযুক্তের অধিকার। তবে একজন অপরাধী যখন জামিন পেয়ে বেরিয়ে ফের অপরাধে জড়ায় তখন সেটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে আমাদের দেখতে হবে তারা জামিন পাচ্ছেন কীভাবে। এক্ষেত্রে বলতে হবে এফআইআর এর দুর্বলতার সুযোগেই জামিন মিলছে। আবার চার্জশিটের দীর্ঘসূত্রতা। চার্জশিট দেয়া হয়নি কিন্তু জেলে রয়েছে, সেক্ষেত্রে দেখা যায় আদালত আসামিকে জামিন দিয়ে দিচ্ছেন। তাই যথোপযুক্ত এফআইআর ও দ্রুত চার্জশিট জমা দেয়া গেলেই ফের বের হয়ে অপরাধে জড়ানো বিষয়টি অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে।

র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এলিট ফোর্স হিসেবে চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ঘটলেই র‌্যাব তা উদঘাটনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অনেক সময়ই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার বিষয়টিও উঠে আসে। তবে র‌্যাব গ্রেপ্তারের পর সংশ্লিষ্ট থানায় আসামিকে সোপর্দ করে। তখন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি আরো বলেন, জনবলের অপর্যাপ্ততার কারণে সব কিছু ফলোআপ করা সম্ভব না হলেও জঙ্গি বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে এমন বিষয়ে আমাদের নজরদারি থাকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App