×

মুক্তচিন্তা

এত ভালো, কতটা ভালো?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:৩৩ এএম

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা করোনার প্রাদুর্ভাব না ঘটলে স্বাভাবিক নিয়মে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসেই পরীক্ষায় বসত। সেই হিসাবে তাদের ৮-৯ মাস দেরিতে পরীক্ষায় বসতে হলো। পরীক্ষাও দিতে হলো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। বাদ রয়ে গেল তাদের বাংলা, ইংরেজি ও চতুর্থ বিষয়। এর ওপর যেসব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তাও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ওপর ভিত্তি করে সীমিত প্রশ্ন ও নম্বরভিত্তিক। করোনা পরিস্থিতিতে এর বিকল্প কর্তৃপক্ষের কিছু করারও সুযোগ ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল, ক্লাস নিতে পারেনি। ছাত্র-শিক্ষকের যোগাযোগটা ছিল অনেকটাই অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক। শহরাঞ্চলের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা অনলাইনে কিছু শ্রেণি পাঠ এবং কোচিংয়ের সহায়তা নিতে পারলেও গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ খুব বেশি পায়নি। ফলে এখানেও একটা বৈষম্য শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই চেপে বসেছিল। কিছু কিছু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক হয়তো কোচিংয়ের সহযোগিতা নিয়েছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও কোচিং খুব একটা বন্ধ থাকেনি। সেটি একটি আপাতবিরোধী-বাস্তবতা! এসব বাস্তবতা মাথায় নিয়েই গত দুই বছর দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হামাগুড়ি দিয়ে চলছে। এখানে কারো ওপর দোষ চাপিয়ে যেমন লাভ নেই, আবার নিয়তির ভাগ্যবরণ বলেও সন্তুষ্ট থাকার উপায় নেই। কারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন থেকে দুটি বছর যেভাবে হারিয়ে গেছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষেই সম্ভব হবে না। ব্যতিক্রম কেবল অল্প কিছু সংখ্যকের ক্ষেত্রেই ঘটবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই দুই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের কত বছর লাগবে তা বলা খুবই কঠিন। তবে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় আবার স্বাভাবিক লেখাপড়া, বাড়তি মনোযোগ দেয়া, পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে নেয়া, প্রস্তুত করা কতটা সম্ভব হবে তা বলা মুশকিল। ফিরে আসা যাক ২০২১ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ফলাফলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে কিছু কথায়। পরীক্ষার ফলাফলকে এক কথায় স্মরণকালের সর্বোচ্চ পাসের হারে শোভা পেতে দেখে অন্যবারের মতো খুব বেশি উচ্ছ¡াস ও আনন্দ প্রকাশের দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সর্বোচ্চ পাসের হার যশোর শিক্ষা বোর্ডে ৯৮.১১ শতাংশ। অকৃতকার্যের হার ১.৮৯ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড, পাসের হার ৯৭.৪৯ শতাংশ; তৃতীয় রাজশাহী, পাসের হার ৯৭.২৯ শতাংশ; চতুর্থ ঢাকা, পাসের হার ৯৬.২০ শতাংশ; পঞ্চম বরিশাল, পাসের হার ৯৫.৭৬ শতাংশ; ষষ্ঠ ময়মনসিংহ, পাসের হার ৯৫.৭১; সপ্তম সিলেট, পাসের হার ৯৪.২০ শতাংশ; অষ্টম দিনাজপুর, পাসের হার ৯২.৪৩ শতাংশ ও নবম চট্টগ্রাম, পাসের হার ৮৯.৩৯ শতাংশ। এখানে শীর্ষে আছে যশোর আর সর্বনিম্নে আছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। ব্যবধান হচ্ছে ৮.৭২ শতাংশ। তাহলে কি ধরে নেব এবার যশোর বোর্ডের শিক্ষার্থীরা পাসের হারে শতভাগ প্রায় ধরেই ফেলেছিল? আর দূরের চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা তাদের থেকে ৮.৭২ শতাংশ নিয়েই পিছিয়ে পড়েছে। ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা মধ্যখানে চতুর্থ স্থান নিয়ে যশোর থেকে প্রায় ২ শতাংশ পিছিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ৬.৮১ শতাংশ এগিয়ে। এসব জটিল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। বোর্ডভিত্তিক ফলাফলের এমন তারতম্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নির্ণয় করা যায় না, তবে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় কিছুটা বৈষম্য তো তৈরি হয়ই। সেটি হতো না যদি এসএসসির এবং এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বর থেকে পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষায় ৭- ৮ নম্বর যোগ না হওয়ার বিধান থাকত, স্রেফ ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করেই মেধার ক্রমতালিকা করা হতো। তা হলে এক ধরনের বাড়তি সুবিধা প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকত না, বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগও ঘটত না। জানি না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন এমন অগ্রহণযোগ্য বিষয়টিকে দীর্ঘদিন থেকে লালন করে আসছে। শিক্ষার্থীর এসএসসি এবং এইচএসসির নম্বর ভর্তি পরীক্ষার আবেদন করার জন্য কেবল বিবেচনা করা যেতে পারে, কিন্তু নতুন কোনো ভর্তি পরীক্ষায় পূর্ববর্তী দুটি পাবলিক পরীক্ষার নম্বর থেকে বাড়তি সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে প্রকৃত মেধাতালিকা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় নির্ধারণ করা কতটা ন্যায়নিষ্ঠ হয় তা বোর্ডভিত্তিক পরীক্ষার ফলের তারতম্য থেকে অনেকটা বোঝা সম্ভব। এবার আলিম পরীক্ষায় পাসের হার ৯৫.৪৯ শতাংশ। পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৯ জন এবং পাস করেছে ১ লাখ ১ হাজার ৭৬৮ জন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮৭২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৯২.৮৫ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৭ জন এবং পাস করেছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৮ জন। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৭৭৫ জন। ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মোট ১১ লাখ ১৫ হাজার ৭০৫ জন, পাস করেছে মোট ১০ লাখ ৬৬ হাজার ২৪২ জন ও জিপিএ ৫ পেয়েছে মোট ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন। শহরের এক সময়কার নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা ফল প্রকাশের দিন নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করত। করোনার কারণেই এবার সেটি ঘটেনি। তবে গ্রামাঞ্চলের অনেক কলেজে পাসের হার, জিপিএ ৫ প্রাপ্তি ইত্যাদি স্বয়ং শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। এতে অভিভাবকরাও উচ্ছ¡সিত হয়েছেন। কিন্তু এই উচ্ছ¡াস কতটা সবার জন্য স্বাভাবিক, কতটা অস্বাভাবিক সেটি বোঝা যাবে যখন জন্ম নেয়া প্রত্যাশা অনুযায়ী উচ্চতর ভর্তি পরীক্ষায় অনেকের জন্যই সাফল্য মিলবে না। তখন একদিকে ধাক্কা খাওয়া, অন্যদিকে পরবর্তী শিক্ষা জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা, সিদ্ধান্তহীনতা, হতাশা ইত্যাদি ভর করবে। তখনই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াবে এই ভালো ফল, এই আলেয়ার মতো বুদ বুদ জাগানিয়া স্বপ্ন। আমাদের পাবলিক পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আমরা এখনো উপলব্ধি করতে পারছি, বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠদানে গড়ে তোলার দায়িত্ব না নিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার এক অদ্ভুত অকল্পনীয় যান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবাইকে আটকে রেখেছে। সত্যিকার মেধা বিকাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতেগোনা। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার কতগুলো শিখন পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পাঠদানের চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোচিংটা এখন রমরমা এবং বাধ্যতামূলকই হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি বাজারে রয়েছে সাফল্যের নিশ্চয়তা হাতছানি দেয়ার গাইড বই! এই দুই মিলেই এখন শিক্ষাব্যবস্থার চলতি নিয়মে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডগুলো পাবলিক পরীক্ষার নামে যে পরীক্ষা পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে জিইয়ে রেখেছে তাতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং ব্যবহারিক পরীক্ষার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা খুব বেশি একটা অজানা বিষয় নয়। এসব নিয়েই পাবলিক পরীক্ষা এবং ফলাফল নিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ! কিন্তু সত্যিকার পঠনপাঠন, পাঠদান, মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীর মেধার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানো এবং উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তায় উদ্ভাসিত করার দায়িত্ব বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো স্তরেই ন্যূনতম পর্যায়ে নেই। সে কারণে আমাদের এই শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতার দৌড় উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষার পর হঠাৎ যেন খাদের কিনারায় এসে অনেককেই কুপোকাত করে দেয়। উচ্চশিক্ষায় যে ধরনের শিক্ষার মান ও গবেষণার সুযোগ দুনিয়াজুড়ে দেখা যায় তার ছিটেফোঁটাও আমাদের উচ্চশিক্ষায় দেখা যায় না। উচ্চশিক্ষার নামে এখন যেসব প্রতিষ্ঠান আমাদের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাচ্ছে তাদের কত শতাংশ সত্যিকার অর্থে মানসম্মত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা থাকার কথা। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই উচ্চশিক্ষার এই স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২১ শতক উপযোগী উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম, পঠনপাঠন, গবেষণা ইত্যাদি প্রদানের ধারে-কাছেও ভিড়তে চাচ্ছে না। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে পাড়ি জমাতে সচেষ্ট, অন্য একটি অংশ অপেক্ষাকৃত কিছু ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হয়, লেখাপড়া শেষে কেউবা স্বদেশে কেউবা বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু সেই উভয় সংখ্যাই শতকরা হারে এইচএসসির কৃতী শিক্ষার্থীর পাসের তালিকার ক্ষুদ্র একটি অংশ। বাকি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নামে উচ্চ হলেও উচ্চতার পরিমাপে খুব বেশি উপরে শিক্ষার্থীদের তুলে আনতে পারছে না। সে কারণেই পাবলিক পরীক্ষার উচ্ছ¡সিত ফলাফল সবার জন্য স্থায়ী মেধার উচ্চ আসন তৈরি করছে না। বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই মানের অধগতির বেশি তেমন কিছু দিতে পারছে না। এটি আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের আপাতবিরোধী বাস্তবতা। এর গোলকধাঁধায় আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। কিন্তু‘ বাস্তব বিশ্ব পরিসরে শিক্ষার মান, সৃজনশীলতা, মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার নিয়মনিষ্ঠ ব্যবস্থা থেকে আমরা যেন ক্রমেই ছিটকে পড়ছি, দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের এখন শিক্ষার সবকিছু নিয়েই বিশ্বজনীন ভাবনা ও করণীয় নির্ধারণ করতেই হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App