×

জাতীয়

অমর একুশে গ্রন্থমেলার পর্দা উঠবে আজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০৫ এএম

উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রকৃতিতে লেগেছে ফাগুনের হাওয়া, বাতাসে বইছে বসন্তের উন্মাদনা। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতিও সেজেছে বর্ণিল সাজে। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। এমনই বৈচিত্র্যময় সময়ে করোনার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ফাগুনের দ্বিতীয় দিনেই আজ দ্বার খুলবে প্রাণের বইমেলায়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার প্রহর শেষে আবারো লেখক-কবি-সাহিত্যিক আর বইপ্রেমিদের পদচারণায় মুখর হবে বইমেলার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী প্রান্তর। বিকেল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বইমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও দেওয়া হবে। এ বছর ১১টি ক্যাটাগরিতে মোট ১৫ জন গুণী সাহিত্যিক এ পুরস্কার পাচ্ছেন। এরপর মেলার মাঠ উন্মুক্ত করে দেয়া হবে সর্বসাধারণের জন্য। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার মেলা একমাস থেকে কমিয়ে ১৪ দিন করা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ২৮ ফেব্রুয়ারির পর মেলার সময় আরো বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও করোনার কারণে গতবারের মতো এবারও মেলায় স্বাস্থ্যবিধির প্রতি থাকবে কড়াকাড়ি। টিকা কার্ড ব্যাতিত কেউ মেলা চত্বরের রেস্টুরেন্টগুলোতে খেতে পারবেন না। মাস্ক পরে ঘুরতে হবে মেলায়। বিষয়টি নিশ্চিত করতে মেলায় থাকবে ভ্রাম্যমান আদালত।

এদিকে আজ মেলা শুরু হলেও এখনো মেলার সব প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি আয়োজন কর্তৃপক্ষ বাংলা একাডেমি। সোমবার বিকেল পর্যন্ত শেষ হয়নি সাজ-সজ্জা, মেলা মাঠের বাউন্ডারি, মাঠে ইট বিছানোসহ আনুসাঙ্গিক কাজগুলো। একই সঙ্গে অধিকাংশ স্টলেরই নির্মাণ ও সাজ-সজ্জার কাজ। এসব কাজ শেষ হতে আরো ৩-৪ দিন লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রকাশকরাও। মেলা গোছানোর কাজ শেষ হয়নি এমন দাবি স্বীকার করে খোদ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, করোনার কারণে মেলা হবে কী না এ নিয়ে আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। তবে মেলা শুরু হওয়ার আগেই সব কাজ শেষ হবে। অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে মেলায় প্রথমদিকে থাকবে না ‘শিশুপ্রহর’। অন্য বছর মেলা ৩ টায় শুরু হলেও এবছর মেলা ২টা থেকে শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিন মেলা শুরু হবে সকাল ১০টা থেকে। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর কেউ মেলা প্রবেশ করতে পারবে না।

রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর পহেলা ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হলেও করোনা মহামারীর উর্ধ্বগতির কারণে গত দুই বছর তাতে ছেদ কাটে। করোনার পরিস্থিতির নিম্নগতি হওয়ায় এবার ১৫ দিন পর শুরু হচ্ছে একুশের চেতনাবহ এই বইমেলা। নানা কারণে এবারের বইমেলাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন আয়োজক ও সাহিত্যিকরা। কারণে হিসেবে তারা বলছেন, এবার ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর। একই সঙ্গে আমাদের সংবিধান প্রণয়নেরও পঞ্চাশ বছর।

সরেজমিনে গতকাল বিকেলে মেলার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গন ঘুরে দেখা যায়, এখনো মেলার সাজসজ্জার কাজ শেষ হয়নি। মেলার সীমানা প্রাচীর বেষ্টনির কাজও রয়েছে অনেকটা বাকি। অধিকাংশ স্টল নির্মাণ কাজও শেষ করতে পারেননি প্রকাশকরা। খোদ বাংলা একাডেমির স্টলগুলোর কাজও শেষ হয়নি। এছাড়াও মেলা মাঠে পয়ঃনিস্কাশন ব্যাবস্থা, নামাজের স্থানসহ সৌন্দর্য্যবর্ধনে জন্য স্থাপিত বিভিন্ন স্থাপনার কাজও বাকি অনেকটা। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে মেলা মাঠজুড়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। কোথাও রঙ ব্রাশের মাখামাখি আবার কোথায় হাতুড়ি পেরেকের সাহায্যে চলছে স্টলের কাজ। আবার কোথাও ইট, বালু, সিমেন্ট এবং স্টিলের ফ্রেমে তৈরি হচ্ছে স্টল।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকাশক বলেন, এবার মেলা অনেকটা অগোলালো অবস্থায় রয়েছে। এখনো মেলা মাঠে ইট বিছানো হয়নাই, সীমানা প্রাচীরের কাজ শেষ হয় নাই, সাজসজ্জার কাজও অনেক বাকি। এছাড়াও অনেক স্টল নির্মাণের কাজও শেষ করা সম্ভব হয়নাই। যা খুবই দুঃখজনক। এই অবস্থা চলতে থাকলে পাঠকের আগ্রহ কমে যাবে।

আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, এতো অগোছালো মেলা বিগত ২০ বছরেও হয় নাই। মেলাতো হবে বাংলা একাডেমি জানে; তাহলে প্রস্তুতি নিতে এতো দেরি হলো কেন?

এবারের বইমেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত বাংলা একাডেমিতে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, কোভিডের কারণে এবার বইমেলার সময়সীমা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন যেভাবে কোভিডের সংক্রমণ কমছে সেভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে হয়তো আমরা মেলার সময়সীমা খানিকটা বাড়াতে পারব।

প্রকাশকদের প্রণোদনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই মেলা হচ্ছে প্রকাশকদের মেলা। তারা একটি মেলার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেন। আমরা কোনোভাবেই চাইবো না, মেলার প্রাণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। গত বছর আমরা তাদের থেকে অর্ধেক ভাড়া নিয়েছি। আর এবার মেলার সময়সীমা যদি বাড়ানো হয় তাহলে আমরা মনে করি সেটি তাদের জন্য প্রণোদনা হবে।

এ সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, মেলায় সার্বক্ষণিক আমাদের একটি মোবাইল কোর্ট থাকবে। যেন গেটে মাস্ক পরে ঢুকে মেলার ভেতরে কেউ মাস্ক ছাড়া থাকতে না পারে। আমরা প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিকে বলেছি, প্রতিটি দোকানে ‘নো মাস্ক নো সেল’ ব্যানার থাকবে।

সচিব বলেন, রেস্টুরেন্টে কোভিড সংক্রমণ বাড়ে। তাই মেলার খাবারের দোকানে ঢুকতে হলে সবার অবশ্যই টিকা সনদ থাকতে হবে। গতকালই আমরা তাদের জানিয়ে দিয়েছি। খাবার আয়োজকদের আমরা জানিয়েছি, তাদের আঙিনায় যেন কেউ টিকা সনদ ছাড়া ঘুরতে না পারে।

বাংলা একাডেমি সূত্র জানায়, এবার বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুট জায়গায়। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪২টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩৪টি ইউনিট; মোট ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭৬টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩৫টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। এবছর লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এমি থিয়েটারের পূর্বদিকে মেলার মূল প্রাঙ্গণে। সেখানে ১২৭টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। মেলায় ওয়াইফাই সুবিধা থাকবে। বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪টি প্রবেশ পথ ও ৩টি বাহির পথ থাকবে।

বইমেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলায় এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বইমেলা পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে। মেলাপ্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। মেলায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ধূলিনাশক পানি ছিটানো এবং প্রতিদিন মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থা থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১০৭টি বই।

মেলায় নতুন সংযোজন: এবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্বাধীনতার মর্মবাণী সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু-গ্রন্থভুক্ত হস্তলিপি বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে স্থাপনাগুলো সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে। লিপি পাঠ করে তরুণেরা বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত হবে। একই সঙ্গে তার চিন্তা ও দর্শনের অন্তর্নিহিত অর্থও উদ্ধার করতে পারবে। মেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ বাস্তবায়ন কমিটি একটি প্যাভিলিয়ন নিয়েছেন। এই প্যাভিলিয়নটি ইতোমধ্যে অনন্য সুন্দররূপে সাজানো হয়েছে। মেলার বিন্যাসেও আনা হয়েছে কিছু পরিবর্তন। গতবার প্যাভিলিয়নগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যখানে রাখা হয়েছিল। এই বিন্যাস অনেকের সমালোচনার মুখে পড়ে বাংলা একাডেমি। ফলে এবার প্যাভিলিয়নগুলো উদ্যানের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

উদ্বোধনী দিনের আয়োজন: বিকেল মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করবেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App