×

জাতীয়

স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব পালন করতে চান আনসাররা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:২৭ এএম

দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা রক্ষায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। নেই কাজের তুলনায় পারিশ্রমিক। অনেকে দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। চাকরি স্থায়ী হতেও কেটে যায় অর্ধযুগ। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগী হিসেবে নির্বাচনী মাঠের শৃঙ্খলা রক্ষা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি বজায় রাখতে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা, বিশ্ব ইজতেমা ও ধর্মীয় উৎসবের সময় অঙ্গীভূত হয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তবে কোথাও স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবে ব্যাটালিয়ন আনসার কাজ করতে পারে না। এজন্য সহযোগী নয়, স্বতন্ত্রভাবে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। তাছাড়া চাকরি স্থায়ীকরণের সময়সীমা কমানোর দাবিও জানিয়ে আসছেন আনসার সদস্যরা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ৪২তম জাতীয় সমাবেশ উপলক্ষে ইতোমধ্যে এ দাবিগুলো এবারও জানিয়েছেন আনসার বাহিনীর সদস্যরা।

এদিকে বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ৪২তম জাতীয় সমাবেশ এবং কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই বাহিনীর। গাজীপুরের সফিপুর একাডেমির এ অনুষ্ঠানে সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও টেলি কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্যারেড পরিদর্শন ও পদকপ্রাপ্তদের পদক পরিয়ে দেবেন। এবার আনসার সদস্য ও কর্মকর্তা মিলে সর্বমোট ১৬২ জনকে পদক দেয়া হচ্ছে। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের প্যারেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করবেন আনসার প্রশিক্ষণের পরিচালক রাজীব হোসাইন।

আনসার ভিডিপির তথ্যমতে, এই বাহিনীর প্রায় ৬১ লাখ সদস্য। আনসার বাহিনীর রয়েছে ব্যাটালিয়ন আনসার, অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা পার্টি (ভিডিপি)। এর মধ্যে ব্যাটালিয়ন আনসাররা স্থায়ী পোস্টে নিয়োগ পান। এই সংখ্যা বর্তমানে ১৭ হাজার ৪১৬ জন। গ্রাম প্রতিরক্ষা পার্টির সদস্য সংখ্যা ৫৭ লাখ। বাকি সব অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার।

আনসার সদস্যদের কাজের ধরন : ব্যাটালিয়ন আনসাররা গুরুত্বপূর্ণ স্থান কিংবা স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন। বিমানবন্দর, হাসপাতাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তারা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্যরা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সম্পত্তি, মার্কেট, হাটবাজার, যানবাহন, ব্যাংক, অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকার ঘোষিত বিশেষায়িত এলাকার যে কোনো সরকারি-বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও এলাকার নিরাপত্তা ও পাহারায় তারা দায়িত্ব পালন করছেন। আনসার সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৪ হাজার ১০টি সংস্থায় প্রায় ৫০ হাজারের মতো অঙ্গীভূত আনসার সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশে প্রায় আড়াই হাজারের মতো অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। এসব আনসার সদস্য পুলিশের সঙ্গে ট্রাফিকের দায়িত্ব ও বিভিন্ন থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে পুলিশের সঙ্গে প্রায় আড়াই হাজারের বেশি ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য ও দুই হাজারের বেশি সাধারণ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরের নিরাপত্তায়ও দায়িত্ব পালন করছেন এসব অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্যরা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই আড়াই হাজারের মতো অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার ও অর্ধশতাধিক ব্যাটালিয়ন আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বলে আনসার সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। যে কোনো নির্বাচনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাধারণ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৫ জন অঙ্গীভূত আনসার সদস্য মারা গেছেন। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রেলপথ ও সড়কপথের নিরাপত্তায় সাধারণ আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ব এজতেমা, দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন উৎসবগুলোর সময় সাধারণ আনসার সদস্যরাই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

সাধারণ আনসার সদস্য লিয়াকত আলী ভুট্টো বলেন, তারা গ্রাম-গঞ্জে সরকারি ত্রাণ পাহারা ও বিতরণে সহযোগিতা, করোনাকালীন মাইকিং, দুর্যোগকালীন সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি জনসচেনতামূলক কাজ করে থাকেন। ৬ মাসে হাতেগোনা কয়েক দিন কাজ থাকে। এর জন্য কোনো বেতন নেই। দৈনিক মজুরিভিত্তিক এ কাজ করতে হয়। তার মতো অনেক সাধারণ আনসার সদস্যের দাবি, তাদের স্থায়ী করা হোক।

অঙ্গীভূত সাধারণ আনসাররাও বলছেন, তিন বছর কাজ করার পর তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ছয়মাসের জন্য বিরতিতে যেতে হয়। ছয়মাস পর নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আনসার সদস্যের কাছে সদর দপ্তর থেকে একটি অফার ম্যাসেজ যাবে। সেই ম্যাসেজে বলা হয়, তিনি কোন জায়গায় পুনরায় কাজে যোগ দেবেন। কিন্তু ছয়মাস পর সেই মেসেজ পেতে লেগে যায় আর আরো তিন থেকে চার মাস। আর এ সময়ে কেউ তাদের খোঁজও নেয় না।

এ বিষয়ে আনসার সদর দপ্তর বলছে, লোকবল বেশি কিন্তু পদ সংখ্যা কম। তাই তিন বছর কাজ করার পর অটোমেটিক অঙ্গীভূত আনসার সদস্যকে বিরতিতে যেতে হয়। পরে তাকে ম্যাসেজ করা হয়, তিনি কাজ করবেন কিনা। তিনি ইয়েস বললে তার কর্মস্থান জানিয়ে দেয়া হয়। তবে অন্যান্য বাহিনীর মতো এ বাহিনীর সদস্যরা চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে স্থায়ী হন না। বর্তমানে ৬ বছর চাকরি করার পর তারা স্থায়ী হতে পারেন। তবে আনসারের পক্ষে এটিকে ২ বছর করার দাবি দীর্ঘদিনের।

তথ্যমতে, ১৯৯৫ সালে আনসার বিদ্রোহের পর তৎকালীন বিএনপি সরকার আনসার ব্যাটালিয়ন আইন তৈরি করে। এই আইনে আনসার সদস্যদের স্থায়ী হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আইনটি সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয়, ১৫ বছর চাকরি করলেই স্থায়ী হওয়া যাবে। এরপর ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার স্থায়ীকরণের মেয়াদ ১৫ থেকে কমিয়ে ১২ বছরে নামিয়ে আনে। এরপর ১২ বছর থেকে তা কমিয়ে ৯ বছর করা হয়। বর্তমান সরকার এটিকে ৬ বছর করে। তবে স্থায়ীকরণের মেয়াদ ২ বছর করা হলে সব সদস্যই স্থায়ী হতেন।

বিগত জাতীয় সমাবেশেও সহযোগী হিসেবে না থেকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন ও স্থায়ীকরণের মেয়াদ কমানোসহ বেশ কিছু দাবিদাওয়া করে আসছিলেন বাহিনীর সদস্যরা। এবারও বেশ কিছু দাবিদাওয়া লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো পূরণ হবে বলে আশাবাদী বাহিনীর সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তবে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন ও চাকরি স্থায়ীকরণের সময়সীমা কমনো- এ দুটি দাবিতে বেশি জোর দিচ্ছেন তারা।

তবে এই বাহিনীর সদস্যদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্থাপন করা হয় আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক। সদস্যদের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের ২৫৯টি শাখা দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদি ঋণ প্রদান করে থাকে। কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকারের শাসনামলে বাহিনীর উন্নয়নমূলক অনেক কাজ হয়েছে। ১৫টি মডেল ব্যাটালিয়নসহ এই বাহিনীর অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীসম্পন্ন ভবন ও স্থাপনা করা হয়েছে। বাহিনীর সদর দপ্তর, রেঞ্জ, জেলা ও ব্যাটালিয়নে ১১২টি বঙ্গবন্ধু কর্ণার নির্মিত হয়েছে।

মুজিব প্রাঙ্গণ এবং অন্যান্য স্থাপনার উদ্বোধন : আজ সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্যারেডে আগমন ও সালাম গ্রহণ করবেন। এরপর আনসার ভিডিপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন পর্যায়ক্রমে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। এরপর বর্তমান সরকারের শাসনামলেই নির্মিত একাডেমিতে নবনির্মিত মুজিব প্রাঙ্গণ, ৯টি শ্রেণিকক্ষ কাম কিচেন-ডাইনিং ভবন, রেঞ্জ কমান্ডার ময়মনসিংহের কার্যালয়, ফেনী জেলা কমান্ড্যান্টের কার্যালয়, ৪টি মডেল উপজেলা কার্যালয় এবং আনসার ভিডিপি একাডেমিতে নির্মিত কেন্দ্রীয় মসজিদের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

পদক পাচ্ছেন ১৬২ জন : বীরত্বপূর্ণ, সাহসিকতাপূর্ণ এবং প্রশংসনীয় কাজের জন্য সর্বমোট ১৬২ জন আনসার সদস্য ও কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ আনসার পদক, প্রেসিডেন্ট আনসার পদক, বাংলাদেশ গ্রাম প্রতিরক্ষা দল পদক, প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ গ্রাম প্রতিরক্ষা দল পদক, বাংলাদেশ আনসার (সেবা) পদক, প্রেসিডেন্ট আনসার (সেবা) পদক, বাংলাদেশ গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (সেবা) পদক, প্রেসিডেন্ট গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (সেবা) পদক দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ পদক পরিয়ে দেবেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ১০ জনকে পদক দেয়া হবে। বাকি পদক প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর পরিয়ে দেয়া হবে। ১০ জনের মধ্যে প্রথম পদক দেয়া হবে অঙ্গীভূত আনসার সদস্য মৃত সাইফুল ইসলামকে। মরণোত্তর পদকটি গ্রহণ করবেন তার স্ত্রী সীমা আক্তার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App