×

খেলা

বিশ্বকাপে যুবা টাইগারদের ভরাডুবি কেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৫৫ পিএম

বিশ্বকাপে যুবা টাইগারদের ভরাডুবি কেন

ক্রীড়া বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান

এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অষ্টম হয়েছে বাংলাদেশের যুবারা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেরে নিজেদের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ করেছে রাকিবুল হাসানের দল। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০২০ সালের আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। তাইতো এ বছর যুবাদের নিয়ে স্বপ্নটা ছিল বড়। তাছাড়া টুর্নামেন্টটির বিগত কয়েকটি আসরে দুর্দান্ত খেলেছিল টাইগাররা। কিন্তু এবার হতাশ করেছে তারা। গতবার ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। এবার ফাইনালে ভারত ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে।

বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতা নিয়ে রবিবার ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান এবং বিশিষ্ট কোচ ও ক্রীড়া বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম।

এবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে ৪ উইকেটে হারিয়ে পঞ্চম শিরোপা জয় করেছে ভারত। গতকালের আগেও অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ছিল বাংলাদেশ। আকবর আলী-শরিফুলদের হাত ধরে ২০২০ সালে বিশ্বকাপ সেরা হয়েছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। শেষ আসরে যুবা টাইগাররা প্রোটিয়াদের মাঠ থেকে শিরোপা নিয়ে ফিরলেও এই আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে তাদের ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। ১৬ দলের বিশ্বকাপে ৮ নম্বর হয়ে এখন দেশের পথে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বড় ব্যবধানে হার দিয়ে যুবারা তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করেছিল। প্রথমে বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও গ্রুপ পর্বের বাকি ম্যাচে জয় নিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হতে পেরেছিল যুবারা। গ্রুপ রানার্সআপ হওয়ার সুবাদে কোয়ালিফায়ার খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল এই আসরে। কোয়ালিফায়ারে টাইগার যুবাদের প্রতিপক্ষ ছিল গত আসরের ফাইনালে পাওয়া ভারত। ২০২০-এ ভারতকে হারিয়ে আকবর আলীরা শিরোপা জয় করে নিয়েছিল। সেই প্রতিশোধ নিতেই এই আসরে রাকিবুল হাসানদের কোয়ালিফায়ারে জয় পেতে দেয়নি ইয়াস ধুলরা। কোয়ালিফায়ারে ভারতে বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরেছে শোচনীয়ভাবে। ব্যাটিং ব্যর্থতার পর বোলিংয়েও প্রথম দিকে সাফল্য ছিনিয়ে নিতে পারেনি। যদিও ইনিংসের মাঝপথে রিপন মন্ডল ভারতীয় শিবিরে উপর্যুপরি আঘাত হেনেছিল। কিন্তু সে সময় ভারতীয় দল অনেকটা জয়ের বন্দরে ছুঁই ছুঁই করেছিল। রিপন মন্ডলের পরপর কয়েকটি উইকেটে আঘাত হানার পরও ভারত জয় নিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে নিয়েছিল। শিরোপা অর্জনের লড়াই থেকে টাইগার যুবাদের ফিরতে হয়েছে সেই কোয়ালিফায়ার থেকেই।

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে টাইগার যুবাদের ব্যর্থতা সম্পর্কে রবিবার ভোরের কাগজকে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ব্যাটিংই ডুবিয়েছে বাংলাদেশকে। তাছাড়া করোনার কারণে এবার যুবাদের প্রস্তুতি ভালো হয়নি। অন্য দলগুলো এবার বেশ উন্নতি করেছে। গতবারের চ্যাম্পিয়নরা এবার অষ্টম হওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাটিং ব্যর্থতা। বোলিং ভালো হয়েছে, ফিল্ডিংও ভালো হয়েছে কিন্তু ব্যাটিংটা একদমই ভালো হয়নি। গতবারের টিমের চেয়ে এবার টিমটা ও তত ভালো ছিল না। দলগত পারফরম্যান্স ভালো হলে ফলাফল ভালো হতো। ব্যাক টু ব্যাক বিশ্বকাপ হওয়ায় যুবারা চাপ সামলাতে পারেনি।

এবার স্থান নির্ধারণী দুটি ম্যাচে ভালো করতে পারেনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। স্থান নির্ধারণীর প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয়। অতঃপর দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাও ২ উইকেটে জয় তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়েছে অষ্টম স্থানে থেকে। অষ্টম স্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা হলে সেখানে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন রিচার্ড স্টোনিয়ার। অবশ্য বাংলাদেশকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে গত আসরে বিশ্বকাপের শিরোপা পাইয়ে দিতে পেছন থেকে লড়েছেন এই রিচার্ড স্টোনিয়ার। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতা দেখে যুব দলের ফিটনেস ও কন্ডিশনিং কোচের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি আর ছোট ছোট বাংলা ভাষায় মজেছেন এদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। আকবর আলীর দলের পর এবার রাকিবুল হাসানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছেন এই ইংলিশম্যান। আলোচনা-সমালোচনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রিচার্ড স্টোনিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন, সেখানে কড়া বার্তায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তোমরা নির্বোধ। মিডিয়া যেসব জিনিস নিয়ে কথা বলছে, তারা কিছুই জানে না। আমি জানি না তোমাদের আবার কেন সময় দিচ্ছি, কিন্তু দিচ্ছি। আমরা হেরেছি, আমরা ভালো খেলিনি, এটা স্পষ্ট। কিন্তু সাতে শেষ করেছি আটে শেষ করেছি এগুলো জঘন্য। ২০২০ সালে যখন বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস গড়েছি, তখন তো তোমাদের এত আলোচনা ছিল না। ছেলেদের একটু বিরতি দাও! তারা ঘুরে দাঁড়াবে তো। ছয় মাস ধরে ছেলেরা জৈব সুরক্ষা বলয়ে আছে। আমার সঙ্গে কোনো মিডিয়া যোগাযোগ করবে না। রিচার্ড স্টোনিয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তিনি মেনে নিয়েছেন টাইগার যুবারা ভালো খেলেনি। প্রথম ম্যাচেই টাইগার যুবারা গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ৯৭ রানে। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড ৭ উইকেটের বিশাল জয় অর্জন করেছে। কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে জয় অর্জন করতে পারায় কোয়ালিফায়ারে গিয়েছিল। সেখানে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষেও গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ১১১ রানে। ইয়াশ ধুলরা ৫ উইকেটের বিনিময়ে খুব সহজেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেছিল। পাকিস্তানের সঙ্গেও আরিফুলের শতক করার পরও বাকি ১০ জন মিলে যোগ করতে পেরেছে মাত্র ৭৫ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শেষ খেলায় পুরো আসরের সর্বোচ্চ রান করেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২৯৪ রানের টার্গেট দিয়েও সপ্তম স্থান নির্ধারণ করতে পারেনি রাকিবুলরা।

এবার বিশ্বকাপে টাইগার যুবাদের ব্যর্থতা সম্পর্কে বিশিষ্ট কোচ ও ক্রীড়া বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম রবিবার ভোরের কাগজকে বলেন, গতবার যে দলটি বিশ্বকাপ জয় করেছে, তারা বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছিল। এবার যারা বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছে, তারা যাওয়ার আগে ম্যাচগুলোয় ভালো খেলতে পারেনি। তাছাড়া গতবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এবারকার দলটি বেশ চাপে ছিল। তারা চ্যাম্পিয়নশিপ অক্ষুণ্ন রাখার চাপে স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেনি। প্রত্যাশার চাপেই ভেঙে পড়েছে ব্যাটিং লাইনআপ। করোনার কারণে প্রস্তুতিও ভালো হয়নি। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ হচ্ছে একটা প্লাটফর্ম। এখান থেকে খেলোয়াড় বেরিয়ে আসে। চ্যাম্পিয়ন কিংবা রানার্সআপ দিয়ে মূল্যায়ন না করে এ আসর থেকে কতজন খেলোয়াড় বেরিয়ে এসেছে, সেটাই দেখার বিষয়। গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল থেকে বেশ কয়েক খেলোয়াড় বেরিয়ে এসেছে। তারা এখন জাতীয় দলসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ভালো করছে।

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ব্যাটিংয়ে এক-দুইজনের রান আসলেও অধিকাংশ ব্যাটারই ছিল ফর্মহীন। তবে বল হাতে রিপন মন্ডলরা অনেক ব্যাটারের মনেই ভীতি ছড়িয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ২০২২ সালের এই আসরে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান করেছে আরিফুল ইসলাম। সবগুলো ম্যাচ না খেললেও দুই শতকে তার মোট রান হয়েছে ২১৫। এছাড়া বাকিরা তার থেকে অনেক পিছিয়ে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইফতিখার হোসেন ইফতির রান ১২৪। ছয় ম্যাচ খেলে ১০০ এর উপরে রান করতে পেরেছে আর মাত্র একজন। ১১৬ রান নিয়ে তৃতীয় যুবা টাইগার হলো মাহফিজুল ইসলাম। বাকিদের মধ্যে মাত্র তিনজন ছিল ৫০-এর উপরে। প্রান্তিক নওরোজ নাবিল ৮৪ রান, রিপন মন্ডল ৫৬ রান এবং আইচ মোল্লা করেছে ৫৫ রান। বাকি সবাই ছিল অর্ধশতকের নিচে। তাদের মাঝে উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ ফাহিম ৪২ রান, আশিকুর জামান ২৫ রান, নাইমুর রহমান ১৬ রান, রাকিবুল হাসান ৭ রান, তাহজিবুল ইসলাম ৪ ও তানজিম হাসান সাকিব করেছে মাত্র ২ রান। এই পরিসংখ্যান শুধু এক ম্যাচের নয়। পুরো আসরে অর্জন করেছে টাইগার যুবারা। ব্যাটিংয়ে অধিকাংশই ফ্লপ থাকলেও বোলিংয়ে আগুনের ফুলকি ছড়িয়েছে রিপন মন্ডল। পুরো আসরে ১৪ উইকেট নিয়ে আসরের সেরা চতুর্থে অবস্থান নিশ্চিত করেছে রিপন মন্ডল। বাকি সবাই ১০টি করে উইকেট পায়নি। সেখানে এস এম মেহেরাব ৬টি, আশিকুর জামান ৪টি, অধিনায়ক রাকিবুল হাসান ৪টি, তানজিম হাসান সাকিব ৩টি, মুশফিক হাসান ২টি এবং আরিফুল ইসলাম, নাইমুর রহমান ও আইচ মোল্লার ঝুলিতে ১টি করে উইকেট আছে। বিশ্বকাপ আসর শেষে আইসিসি সেরা একাদশ ঘোষণা করেছে। সেখানে বাংলাদেশের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে রিপন মন্ডলের নাম এসেছে।

২০২২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেরা একাদশ :  হাসিবুল্লাহ খান (উইকেটরক্ষক, পাকিস্তান), টিগ উইলি (অস্ট্রেলিয়া), দাওলোদ ব্রেভিস (দক্ষিণ আফ্রিকা), ইয়াশ ধুল (অধিনায়ক, ভারত), টম প্রেস্ত (ইংল্যান্ড), দুনিথ ওয়েলেলাগে (শ্রীলঙ্কা), রাজ বাওয়া (ভারত), ভিকি ওস্তাওয়াল (ভারত), রিপন মণ্ডল (বাংলাদেশ), আওয়াইস আলী (পাকিস্তান) ও জশ বয়ডেন (ইংল্যান্ড)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App