×

জাতীয়

পাহাড়ে কেন বারবার রক্তপাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৪৩ এএম

পাহাড়ে কেন বারবার রক্তপাত

পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহতদের স্বজনের আহাজারি। ছবি: ভোরের কাগজ

আধিপত্য বিস্তারের লড়াই

বেড়েছে টার্গেট কিলিং

অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধের তাগিদ

সবুজ পাহাড়ে ফের রক্তের ছোপ। বেড়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। বেড়েছে টার্গেট কিলিং মিশন। থেমে নেই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। হামলা-পাল্টা হামলায় কাঁপছে পাহাড়। গত এক বছরে তিন পার্বত্য জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন। গত বুধবার রাতে আবারো রক্তাক্ত হয়ে ওঠে পাহাড়ি জনপদ। বান্দরবানের রুমায় সন্ত্রাসীদের এলোপাতারি গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর টহল কমান্ডার সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান। গুলিবিদ্ধ হন সৈনিক ফিরোজ। এ সময় সেনাবাহিনীর পাল্টা গুলিতে মারা যায় তিন সন্ত্রাসী। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জোরালো অবস্থান, পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনীর অভিযান আরো জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বহুমুখী ও জটিল। রাজনৈতিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান হতে হবে। নতুবা রক্তাক্ত পাহাড়ের কান্না থামানো অসম্ভব। এ ব্যাপারে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, পার্বত্য এলাকার জটিল পরিস্থিতি কার স্বার্থে? চুক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই, এটি বোঝার বাকি থাকে না। চুক্তির পর পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইছিল। কিন্তু চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সশস্ত্রবাহিনীর উত্থান ঘটেছে। পার্বত্যবাসীর ভূমি সমস্যার সমাধান হলে, চুক্তি বাস্তবায়িত হলে সমস্যা কমবে। তিনি বলেন, পাহাড়ে কার্যত সেনাশাসন চলছে। নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব বেশি। তবুও অস্থির পাহাড়। এই জটিল সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে মেটাতে হবে।

জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ভোরের কাগজকে বলেন, চুক্তির যে সফট জায়গাগুলো রয়েছে যেমন কল্যাণমূলক, আয়বর্ধক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এসব জায়গায় কাজ বেশি হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির জায়গায় যে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন দেয়া, আঞ্চলিক পরিষদকে শক্তিশালী করা, অভ্যন্তরীণ ভোটার লিস্ট ঠিক করা, শরণার্থী, ভূমি ক্ষেত্রে চুক্তি যাদের সঙ্গে করা হয়েছিল সেই জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। ভূমি কমিশন হয়েছে, আইনেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে যা ইতিবাচক; তা সত্ত্বেও চুক্তির বেশ কিছু জায়গায় এখনো অনেক প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ডায়লগ হচ্ছে না। এসব কারণে অভ্যন্তরীণ বিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফলশ্রুতিতে রক্তপাত হচ্ছে। এটি বেশ জটিল। রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। অস্ত্র দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন এই গবেষক।

বছরজুড়ে উত্তপ্ত পাহাড় : সদ্য বিদায়ী বছর পুরোটাই উত্তপ্ত ছিল পাহাড়। ১৯ জানুয়ারি বিলাইছড়িতে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সাতজনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। ১১ ফেব্রুয়ারি লামায় ছাত্রী অপহরণের ঘটনা ঘটে। ১৮ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়িতে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে গভীর রাতে গুলি বিনিময়। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে বাঘাইছড়ি রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সমর বিকাশ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২ মার্চ খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় অস্ত্র, গুলি, ম্যাগজিন, নগদ অর্থসহ চার সন্ত্রাসীকে আটক করে যৌথ বাহিনী। ৪ মার্চ রাঙ্গামাটির লংগদু নদীতে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার। ১ এপ্রিল রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সহকর্মীর গুলিতে বিশ্ব চাকমা নিহত হন। ২৯ এপ্রিল বান্দরবানে সেনা অভিযানে ভারী মারণাস্ত্রের গুলি, বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধার। ১৫ জুন রাঙ্গামাটি জুরাছড়ি উপজেলার লুলাংছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে কার্বারি (গ্রাম প্রধান) নিহত হন। ২০ জুন বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে। ২৭ জুন খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় ইউপিডিএফের কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৮ জুন বান্দনবানের নাইক্ষংছড়ির সীমান্তে অজ্ঞাত পুরুষের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়। ১০ জুলাই রাঙ্গামাটি রাইখালীতে সন্ত্রাসী দলের দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন একজন। একই দিন খাগড়াছড়ির গুইমারাতে সেনাবাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ চারজন ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী ধরা পড়ে। ১৮ জুলাই খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খল কুমার ত্রিপুরা নামে এক যুবক নিহত হন। ১৯ জুলাই বান্দরবানে এক পল্লী চিকিৎসককে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা হয়। ২৫ জুলাই রাঙ্গামাটি মগবান এলাকায় বাসিরাম তংচঙ্গ্যা নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ১ আগস্ট রাঙ্গামাটি সেনাবাহিনীর অভিযানে এ কে ২২ রাইফেল, ৭৭ রাউন্ড গুলি, অ্যামুনিশান, ১টি ম্যাগজিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ৬ আগস্ট খাগড়াছড়ির পানছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ইউপিডিএফ মূল দলের গুলি বিনিময় অস্ত্র ও অ্যামেনিশানসহ আটক হয় এক সন্ত্রাসী। একই দিনে রাঙ্গামাটি রাজস্থলীতে জে এস এসের মূল দলের কালেক্টরকে আটক করে যৌথ বাহিনী। ৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ইউপিডিএফ চিফ টোল কালেক্টর লালন চাকমা অস্ত্রসহ আটক হন। ৯ আগস্ট রাজস্থলীতে সেনাবাহিনীর অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার। ১০ আগস্ট খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে সেনা অভিযানে ইউপিডিএফ মূল দলের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আটক, চাইনিজ পিস্তল, ম্যাগজিন, ৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার। ১৪ আগস্ট রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়িতে সেনা অভিযানে ইউপিডিএফ (প্রসিত) গ্রুপের দুই সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আটক। একই দিনে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে সেনা অভিযানে অস্ত্র ও গুলিসহ ইউপিডিএফ মূল দলের একজন আটক। ২০ আগস্ট বান্দরবান বিজিবি অভিযানে ৩টি মর্টাল শেল ও দুটি আর এল গোলা উদ্ধার। ২৩ আগস্ট রাঙ্গামাটির জুরাছড়িতে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় সেনা অভিযানে একে-৪৭সহ শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার। ২৩ আগস্ট বান্দরবানে রুমায় দুর্গম এলাকার মাটির নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১২টি মর্টাল শেল উদ্ধার। ২৪ আগস্ট রাঙ্গামাটি জীবতলী এলাকা সেনা অভিযানে ২টি অত্যাধুনিক আগ্নেযাস্ত্র ও তাজা গুলিসহ একজন আটক। ২৭ আগস্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ইছাছড়ি এলাকার পাহাড়ের ঢালুতে যুবকের মরদেহ লাশ উদ্ধার। ১৭ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়ির মধ্যম বঙ্গলতলী এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে একজন নিহত। ১৮ সেপ্টেম্বর বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাসায় নিহত হয় সুরেশ চাকমা। ২৪ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি সদরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র, গুলিসহ জনসংহতি সমিতির কালেক্টর পুনেন্টু চাকমা আটক। ১৬ অক্টোবর রাঙ্গামাটি কাপ্তাই চিৎমরমে আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে গুলি করে হত্যা। ২৫ অক্টোবর রাঙ্গামাটি কাপ্তাইয়ে অস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলিসহ একজন আটক। ১৫ নভেম্বর রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ২নং গাইন্দা ইউনিয়নের তাইতংপাড়ায় নিউরো সার্জন ডা. রেনিন সু তালুকদারকে হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলি। ২৩ নভেম্বর বান্দরবানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আওয়ামী লীগের নেতা উথোয়ানু মারমা নিহত হন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন তার স্ত্রী। ২৬ নভেম্বর রাঙ্গামাটি বন্দুক ভাঙায় সন্ত্রাসীদের আস্তানায় অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। ১৩ ডিসেম্বর বান্দরবান সদর উপজেলার ডলুপাড়া থেকে অপহৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বান্দরবান জেলা কমিটির সদস্য ও বান্দরবান থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পুশৈথোয়াইর অপহরণের পর হত্যা করা হয়; পরে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় তার লাশ। ১৪ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলায় অস্ত্রের মুখে দুই গ্রামবাসীকে অপহরণ হয়। ২৫ ডিসেম্বর বান্দরবা?নের রাজবিলার রমতিয়াপাড়া এলাকায় কিরণময় তঞ্চঙ্গ?্যা নামে একজনকে অ?স্ত্রের মু?খে অপহর?ণ হয়। ২৭ ডিসেম্বর পানছড়ি পাহাড়ি যুবকের তথ্যের ভিত্তিতে হবিগঞ্জের সাতছড়ি থেকে ১৫টি মর্টার শেল, ২৫টি বুস্টার ও ৫১০ রাউন্ড অটো মেশিনগানের গুলিসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির ২ কিলো নামক স্থানে আঞ্চলিক দুই গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন দুজন। আহত হন একজন। পরে অভিযান চালিয়ে একে ৪৭ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি দিঘিনালায় সেনাবাহিনীর অভিযানে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধের দাবি : সেনা হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার ভোরের কাগজকে বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আমার কণ্ঠ সব সময় সোচ্চার। সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রতিনিয়ত কাজ করছে। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আবারো পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে পাহাড়ের মানুষের শান্তি আবারো বিঘ্নিত হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান আরো জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানান তিনি।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান ভোরের কাগজকে বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা কারো কাম্য নয়। আমরা পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চাই। পার্বত্য অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো জোড়ালো ভূমিকা পালনের দাবি জানান তিনি।

পার্বত্য রাঙ্গামাটির সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না ভোরের কাগজকে বলেন, পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রের কারণে পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ খুবই শঙ্কিত। পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র যতদিন উদ্ধার হবে না ততদিন এই রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App