×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধাচার চর্চা ও প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০৯ এএম

ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে একটিমাত্র বিষয়ের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছিল, সেটি হচ্ছে আস্থা বা বিশ্বাস। অর্থাৎ আদিযুগে মানুষ নগদ অর্থকড়ি কিংবা সোনাদানা ঘরে জমিয়ে বা লুকিয়ে রাখার চেয়ে গির্জা বা মন্দিরের সিন্দুকে রাখাকে অধিকতর নিরাপদ মনে করত। কিন্তু আয় বা প্রতিদান ছাড়া এ রকম অলাভজনকভাবে সম্পদ জমিয়ে না রেখে তার বিপরীতে বিশ্বাসের সঙ্গে লাভ বা সুদ আয় শ্রেয়তর বিবেচিত হয়েছিল বলেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ব্যাংকিং সেবার ক্রম জটিলতর বিবর্তন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘটিত বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংকট ও কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের পর ব্যাংকিং সেবা ও পেশায় নৈতিকতার প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আর্থিক খাতে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক সাম্য, সুবিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল হিসেবে সরকারের কাছে বিবেচিত হয়েছে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই শুদ্ধাচার অনুশীলন অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। এটিকে এড়িয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে আর্থিক সেক্টর শুদ্ধাচার অনুশীলন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর্থিক সেক্টর একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ সেক্টর। এখানে আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সব বিষয়ে আবর্তিত হয় বিধায় বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অসাধুতা, অনৈতিকতার চর্চা যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ প্রয়োজন। রাষ্ট্র ও সমাজ দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের রূপকল্প হচ্ছে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। আমাদের সবার কাক্সিক্ষত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আমাদের সব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের আর্থিক খাত। এখানে শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং সর্বোপরি শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের আশা করা যায় না। আর্থিক খাতে শুদ্ধাচারের চর্চা না থাকলে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, দুর্নীতি বাসা বাঁধে সেখানে। তখন সব সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া চরম হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ব্যাংক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। ব্যাংক ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তার মন্দ প্রভাব পড়তে থাকে গোটা অর্থনীতিতে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়ন, অগ্রগতির স্বার্থে সবাই একটি শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করে। দেশের সব ব্যাংককে এখন কঠিন সময়ের মোকাবিলা করে এগোতে হচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত কিছু বিপর্যয় ও প্রতিকূল পরিস্থিতি গোটা ব্যাংক ব্যবস্থায় অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। গত এক-দেড় দশকে বাংলাদেশে আর্থিক খাতে সংঘটিত বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, অর্থ লোপাটের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো সবাইকে হতবাক করেছে যুবক, ডেসটিনি, হলমার্ক কিংবা বিসমিল্লাহ গ্রুপ। প্রভৃতি নাম উচ্চারিত হতেই জনমনে এক ধরনের ঘৃণা, অস্বস্তি, অভক্তি ভাব জেগে ওঠতে দেখা যায়। ব্যাংক খাতে সংঘটিত এসব অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ লোপাটের ঘটনাগুলো এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। সবাই আজকাল নিজের গা বাঁচাতেই যেন বেশি ব্যস্ত। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বড় বড় ঋণগ্রহীতারা তা ফেরত দিতে চায় না, ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রায় ক্ষেত্রে বড় বড় ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খান, বাধার সম্মুখীন হন। এসব কারণে এখন ব্যাংক খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে স্থবিরতা, অনাগ্রহ। আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে যে ব্যাংকিং ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটেছে পৃথিবীব্যাপী তা শুদ্ধাচার এবং নৈতিকতার অভাবে অনেকটাই হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। ব্যাংকে প্রতারণা, ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি বাড়ছে। যতই অনাকাক্সিক্ষত হোক না কেন দেশে ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে অনিয়ম। ভুয়া বন্ধকির মাধ্যমে অস্তিত্বহীন ও ঋণ পরিশোধে অযোগ্য, অক্ষম প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া জমি, সরকারি খাসজমি মর্টগেজ রেখে ঋণ দেয়া, পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণ, শ্রেণিকৃত দায় থাকার পরও ত্রæটিপূর্ণ সহায়ক জামানতের বিপরীতে এবং গ্রাহকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ঋণ দেয়ার ঘটনা হরদম ঘটছে। কিন্তু এসব অনিয়ম এবং হয়রানি বন্ধে নেয়া হচ্ছে না তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। এভাবেই দিন দিন ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। ব্যাংকিংও যে এক ধরনের ব্যবসা, এটা যেমন সত্যি, তেমনি ব্যাংক যে অন্যের আমানত নিয়ে ব্যবসা করে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। ঠিক এ কারণে অন্যান্য ব্যবসা-প্রয়াসের চেয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে মানুষ অধিকতর নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে। ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে তথা ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধতা থাকবে, স্বচ্ছতা থাকবে- এটা যে কোনো গ্রাহক মনে মনে প্রত্যাশা করেন। ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে নৈতিকতার কোনো বিরোধ নেই। বরং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধাচার আবশ্যিক ব্যাপার হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। যদি ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা-অনিয়ম গ্রাস করে, তাহলে সেখানে শুদ্ধতা আশা করা যায় না। মূলত নৈতিকতা বিবর্জিত কাজের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকারদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমারেখা নির্ধারণ করা উচিত। প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে কেবল উচ্চবিত্ত মুষ্টিমেয় কিছু গ্রাহকের মধ্যে ঋণসুবিধা সীমিত রাখা, সহায়ক জামানতবিহীন সাধারণ মানুষ এবং দরিদ্রদের জন্য ঋণ গ্রহণের সুযোগ না রাখা, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে ব্যাংককে বিপদগ্রস্ত করা কিংবা দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনো উদ্যোগে ঋণসুবিধা দেয়া- এসবকেই ব্যাংকিং খাতের অনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অনৈতিক কর্ম এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে নিজেরাই অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া- এসবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা উচিত। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিকতাহীনতা খুব স্বাভাবিকভাবে চলে আসে- এ রকম কথা বলতে চান অনেকেই। ব্যাংকিংয়ে নৈতিকতার বিষয়টিকে পরস্পরবিরোধী বলে যে ধারণা প্রচারিত হচ্ছে, তা দূর করার জন্য ব্যাংকগুলোকে আইনের শাসন বাড়ানোর লক্ষ্যে যে কোনো ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। কার্যক্রমের সব পর্যায়ের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। স্বল্প মেয়াদে মুনাফার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো ধরনের ঝুঁকি গ্রহণের চেষ্টা পরিহার করতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে, ব্যাংক যেমন কোনো খয়রাতি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, তেমনি জনগণ তথা সাধারণ আমানতকারীদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য নৈতিক ব্যবসা পরিচালনা করাই ব্যাংকের দায়িত্ব। যেখানে শুদ্ধাচারই হবে সব কর্মকাণ্ডের ভিত্তি, যেখানে স্বচ্ছতা থাকবে প্রতিটি স্তরেই। এসব কারণেই অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংকের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট কঠোর ও নিবিড় হওয়া উচিত। ব্যাংক জনগণ, জনগণের অর্থ বা অর্থের সমমূল্য পণ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়, ব্যবসা করে। মানুষ সবসময়ই উচ্চাকাক্সক্ষী এবং অর্থ হলো একটি স্পর্শকাতর সম্পদ। কাজেই মানসম্মত গ্রাহকসেবা ও বিশ্বাসযোগ্যতা- দুটিই ব্যাংকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ দুটি বিষয় প্রধানত নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতার চর্চার ওপর। গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, পরিপালন, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা প্রভৃতি মৌলিক আদর্শ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা বা চর্চা নিশ্চিত করা হলে ব্যাংক তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তেমন কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবে না। অতএব ব্যাংক ব্যবস্থাপনার শুদ্ধাচার চর্চা ও প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে আন্তরিক এবং নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। ব্যাংক খাত হলো দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। এ খাতে বিপর্যয় নেমে এলে গোটা অর্থনীতিই অনিশ্চয়তা ও ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অতএব আমাদের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা সমুন্নত রেখে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ অবস্থানের দিকে এগিয়ে যেতে হলে সামগ্রিক অর্থনীতির শক্ত অবস্থান সৃষ্টি একান্ত জরুরি। আর এজন্য ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের মাত্রা দ্রুত সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App