×

অপরাধ

পরকীয়ায় বাধা দেয়াই কাল হয় বৃষ্টির

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:৩৯ পিএম

পরকীয়ায় বাধা দেয়াই কাল হয় বৃষ্টির

সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে বৃষ্টি হত্যা মামলার প্রধান আসামি মো. আসাদুল ইসলামকে হাজির করা হয়। ছবি: ভোরের কাগজ

পরকীয়ায় বাধা দেয়া এবং আগের ঘরের সন্তানদের কাছে টাকা দিতে চেয়েছিলেন মোছা. বৃষ্টি আক্তার (২৩)। কিন্তু সেটিই তার জীবনে কাল হলো। গত ১৩ জানুয়ারি দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে নারীঘটিত বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিল তার। এরই এক পর্যায়ে স্বামী মো. আসাদুল ইসলাম শ্বাসরোধে হত্যা করে তাকে।

হত্যার বিষয়টি আড়াল করতেই একে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এ উদ্দেশ্যে স্ত্রীর মরদেহ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর সারা রাত সেই ঘরে অবস্থান করলেও পরদিন ভোরবেলায় ভয়ে স্ত্রীর মরদেহ নামিয়ে রেখে পালিয়ে যান।

সোমবার (৩১ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে বৃষ্টি হত্যা মামলার প্রধান আসামি মো. আসাদুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর কমান্ডিং অফিসার অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ১৫ জানুয়ারি দুপুরে আশুলিয়ার কাঠগড়া সরকারবাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাসা থেকে বৃষ্টি আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন রাতেই আসাদুলসহ প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে যে কারণে ২য় বিয়ে করেন মোছা. বৃষ্টি আক্তার (২৩) সেই কারণই তার মরণ কামড় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম জনের মতোই ২য় স্বামী মো. আসাদুল ইসলামও (২৬) অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ায় ফের সংসারে অশান্তি নেমে আসে। প্রতিনিয়তই তাদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ হতো। আর এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ জানুয়ারি নারীঘটিত বিষয় নিয়ে ফের স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ হয়। এক পর্যায়ে স্ত্রী বৃষ্টিকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আসাদুল। হত্যার পর বিষয়টিকে আত্মহত্যার ঘটনা সাজাতে তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে তার পাশেই সারা রাত বসে থাকে সে। তবে ভোরে ভয় পেয়ে পরে স্ত্রীকে নামিয়ে পালিয়ে যায় সে। মূলত পরকীয়ার আসক্তিতে বাধা দেয়া ও আগের ঘরের সন্তানদের টাকা দিতে চাওয়াতেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে।

মোজাম্মেল হক আরও বলেন, গত ১৫ জানুয়ারি দুপুরে আশুলিয়ার কাঠগড়া সরকারবাড়ী এলাকার ভাড়া বাড়ির একটি কক্ষ থেকে বৃষ্টি আক্তার নামের এক নারীর লাশ আশুলিয়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ওইদিন রাতেই আসাদুলসহ অজ্ঞাত কয়েক জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় র‍্যাব-৪ এর একটি গোয়েন্দা দল পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তের একপর্যায়ে র‍্যাবের গোয়েন্দা তথ্য ও স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে জানা যায়, এ হত্যা মামলার মূল অভিযুক্ত আসাদুল নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার কোনো এক এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত রবিবার (৩০ জানুয়ারি) র‍্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানাধীন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে মো. আসাদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারকৃত আসাদুল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ভিকটিম মোছা. বৃষ্টি আক্তার কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানাধীন এলাকার মেয়ে। গত ২০১২ সালে ভিকটিম বৃষ্টির প্রথম বিবাহ হয়। প্রথম স্বামীর সংসারে তার ৬ বছর ও ৪ বছরের দুই মেয়ে রয়েছে যারা ডিকটিমের বড় বোন আকলিমার কাছে থাকত। গত ২০১৯ সালে ভিকটিমের প্রথম স্বামী ভিকটিমকে না জানিয়ে অন্য এক নারীকে বিবাহ করলে বৃষ্টি আর সংসার করবে না বলে জানায়।

এক পর্যায়ে বৃষ্টির প্রথম স্বামী বৃষ্টিকে তালাক দেয়। ভিকটিম বৃষ্টি এরপর গাজীপুরে তার বোনের সঙ্গে থেকে গার্মেন্টসে চাকুরী শুরু করে। এ সময়ই আসামি আসাদুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। তবে আসাদুল লোভী ও ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় ভিকটিম বৃষ্টির তালাকের টাকার জন্য কৌশলে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে ও এক পর্যায়ে ভিকটিমকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে বিয়েতে রাজি করায়।

গত বছর ১ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে আসামি আসাদ বৃষ্টির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের পূর্বে আসাদুল বৃষ্টির প্রতি অনেক যত্নশীলতা ও সহমর্মিতা দেখাতো, কিন্তু বিয়ের পর পরই তার রূপ পাল্টে যায়। সে বৃষ্টির পূর্বের স্বামীর সঙ্গে তালাকের পর প্রাপ্ত অর্থ ও মাসিক বেতনের উপর লোভাতুর দৃষ্টি দেয়। বিয়ের পর তারা গাজীপুরে থাকা অবস্থায় তাদের মাঝে মাঝেই দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হত। পরে তারা গাজীপুর থেকে আশুলিয়ায় এসে একটি গার্মেন্টস এ চাকুরী নিয়ে গার্মেন্টসের কাছে বাসা ভাড়া নেয়। তারা দুজনেই একই মোবাইল ব্যবহার করত ও বৃষ্টির ১৮ হাজার এবং আসাদুলের ১২ হাজার টাকা বেতন সেই মোবাইলেই আসত। বেতনের টাকা আসামী আসাদ উত্তোলন করত।

তিনি আরও বলেন, বৃষ্টির প্রথম পক্ষের দুই সন্তান থাকায় তাকে সন্তানদের খরচ দিতে হতো। ফলে সে আসাদের কাছে বেতনের উত্তোলনকৃত অর্থ চাইত কিন্তু আসাদ এ সংক্রান্ত কোনো খরচ দিতে চাইত না তাছাড়াও বৃষ্টির হাতখরচের জন্যও কোনো টাকা দিত না। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃত আসামী আসাদ একাধিক পরনারীতে আসক্ত হলে তাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে।

আশুলিয়ায় গত ৩-৪ মাস পূর্বে আসাদের পরকীয়াকে কেন্দ্র করে তারা বাসা পরিবর্তন করে বর্তমান বাসায় আসে। এখানেও আসাদ অন্য মেয়েদের সঙ্গে মোবাইল ফোন, ইমো ভিডিও কল ও ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ রাখত। ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ১৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতের দিকে আসাদুল বাসায় ফিরলে ভিকটিম বৃষ্টি আসাদের মোবাইলে অন্য নারীর অপ্রীতিকর ছবি, কথপোকথন দেখতে পেয়ে রাগ করে আমাদের মোবাইল ভেঙে ফেলে, আসাদও ক্ষিপ্ত হয়ে বৃষ্টির কিস্তির টাকায় কেনা টিভি ভেঙে ফেলে। এতেও উগ্র মেজাজ প্রশমিত না হলে আসাদ ভিকটিম বৃষ্টির গলা টিপে ধরে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ওড়না বা অন্য কোনো কাপড় দিয়ে শ্বাসরোধ করে আসাদ ভিকটিমকে হত্যা করে।

আসাদের বক্তব্য অনুযায়ী বৃষ্টির মৃত্যু পরবর্তীতে আত্মহত্যার ঘটনা বানাতে সে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। তবে পরে সিলিং ফ্যান থেকে নামিয়ে তার পরিহিত লুঙ্গি দিয়ে মৃত ভিকটিমের মুখ ঢেকে রাখে। বিষয়টি আসাদ তার মা ও ফুপুকে জানিয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। পরবর্তী দিন অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি বিকেলে আসাদের ওই ফুপু ভিকটিমের বড় বোন আকলিমাকে মোবাইলে কল করে বলে বৃষ্টি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে, এলেই দেখতে পাবেন বলে সে তার মোবাইল বন্ধ করে দেয়।

একই দিন সন্ধ্যার দিকে আসামীর মা-ও ভিকটিমের পরিবারকে মোবাইলে কল করে বলে ভিকটিম বৃষ্টি মারা গেছে ও সে-ও মোবাইল বন্ধ করে দেয়। ভিকটিমের পরিবারের আসামী আসাদ ও বৃষ্টির নতুন বাসার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা ছিল না। ভিকটিমের ভাই গাজীপুর থেকে সাভারের আশুলিয়ায় এসে সন্ধ্যা থেকে সারারাত অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বৃষ্টির কোনো ঠিকানা না পেয়ে আশুলিয়া থানায় যোগাযোগ করে।

ইতোমধ্যে ভিকটিমের পরিবার বৃষ্টির কোনো ঠিকানা না পাওয়ার কারণে ১৫ জানুয়ারি তারা কয়েকজন মিলে আসাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে গিয়ে বৃষ্টি ও আসাদের ঠিকানা দিতে আসাদের মাকে চাপ প্রয়োগ করে। চাপ প্রয়োগের এক পর্যায়ে আমাদের মা তাদের সাভারের আশুলিয়ায় সরকার বাড়ির ঠিকানা দেয়। এরপর ওইদিন দুপুরের দিকে ভিকটিমের আপন ভাই ও খালাতো ভাই আশুলিয়ায় সরকার বাড়িতে গিয়ে দরজা তালাবদ্ধ পেয়ে দরজার নিচের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পা দেখতে পেয়ে আশুলিয়া থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে ভিকটিমের ঘরের তালা ভেঙে ভিকটিমের লাশ উদ্ধার করে।

থানা পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে ভিকটিমের শরীরে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় এবং ধারণা করা হচ্ছে বৃষ্টিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়া গেলে হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন হবে। তবে র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আসামী আসাদ বৃষ্টি হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App