×

পুরনো খবর

অবহেলিত হিজড়ারাও পারে দেশ গড়ায় ভূমিকা রাখতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৪২ পিএম

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, হিজড়া নামেই যাদের পরিচিতি বেশি এ সমাজে। তাদের কথা উঠলেই অনেকের মাঝে একটি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। অচ্ছুৎ-অপাঙক্তেয় হিসেবে দূরে ঠেলে দেয়া হয় তাদের। সবার অবহেলায় কোণঠাসা এই জনগোষ্ঠীর জীবনে শুধুই বেদনার ঢেউ। কিন্তু যদি তাদেরকে ভালোবেসে নেয়া হয় সৃষ্টিশীল পদক্ষেপ, তবে তারাই হয়ে উঠতে পারেন এ সমাজের, দেশের, রাষ্ট্রের মূল্যবান জনসম্পদ। বদলে দিতে পারেন তাদের নিয়ে নেতিবাচক সব ধ্যান-ধারণা।

বর্তমানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হিজড়াদের অংশগ্রহণ আশান্বিত করছে সবাইকে। ‘আশাবাদী হওয়া’ বা ‘বি পজিটিভ’ - এমন মনোভাব দেখা গেছে রাজধানীর মিরপুরের বসবাসকারী হিজড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে কোরআন তেলওয়াত, কবিতা আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশন করেন তারা। দেখানো হয় তাদের অভিনীত তথ্যচিত্র। প্রতিটি পরিবেশনাই ছিল মনোমুগ্ধকর। এই আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিল আফরাজান ফাউন্ডেশন।

তথ্যচিত্রে দেখানো হয়, কীভাবে ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠে তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলো। যেখানে অবহেলা-চোখ রাঙানি ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। একসময় পরিবারেও তাদের ঠাঁই হয় না। বাধ্য হয়ে তারা আশ্রয় নেয় অন্য হিজড়াদের কাছে, হিজড়া থানে (থানে মানে আস্তানা)।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান নিয়ে কাজ করছে আফরাজান ফাউন্ডেশন। সংগঠনটি হিজড়াদের পারিবারিক ও আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বয়স্ক ভাতা আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা হয় আফরাজান ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরাবী বিনতে সাদেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য যেন যোগ্যতা ও সম্মানের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো বা হিজড়া জনগোষ্ঠী কাজ এবং সমাজে একটা অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেন। আমরা হয়তো তাদের অনার্স-মাস্টার্স করিয়ে ব্যাংকে চাকরি দিতে পারব না, কিন্তু তারা যেন সফল হন সে চেষ্টা করে যেতে পারব।

জানা গেল, রাজধানীর গুলশান, মোহাম্মদপুর ও আরো কিছু এলাকা ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বেশকিছু জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে সংগঠনটি। এ সম্পর্কে ফাহরাবী বলেন, আমার তত্ত্বাবধানে সম্মানের সঙ্গে ইতোমধ্যে তারা লাইন মিউজিক, মেহেদি উৎসব, গান-বাজনা, রান্নাবান্না ও বেকারি এবং ব্লক-বাটিকের কাজ করছেন। আমি তাদের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেইনআপ করাচ্ছি, যেন নিজেদের যোগ্যতায় কাজ করে যেতে পারেন।

হিজড়াদের শিক্ষাগত পরিবর্তন আনার বিষয়ে ফাহরাবী বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের ধর্মীয় জ্ঞান থাকা দরকার। সেই শিক্ষার কাজটিও শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা শুরু হতেও হয়তো আর বেশি সময় বাকি নেই। আমি তাদের সবাইকে আমার মেয়ের মতো দেখি। সবাইকে তো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারব না। আমি চাই, সবাই যেন সম্মানের সঙ্গে একত্রে বসবাস করতে পারি।

অবহেলিত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিকূলতার বিষয়ে ফাহরাবী বলেন, এই সেক্টর অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য সহজে কোনো রেস্টুরেন্ট পাই না। এই যে প্রতিকূলতা ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়, আমার চ্যালেঞ্জ সেখানে। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চাই, যেন সবাই খুব সহজে তাদের গ্রহণ করেন। আমি নারী হিসেবে অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসেছি। আশা করছি, তাদের নিয়ে সব ক্ষেত্রে সব বাধা দূর করতে পারব।

রাজধানীর গুলশানে ‘হিজড়াদের নানি’ নামে পরিচিত এক প্রবীণা এই প্রতিনিধিকে বলেন, আমাদের কোনো কর্মক্ষেত্র নেই। বয়স বাড়লে আমরা আগের মতো করে রাস্তায় গিয়ে টাকা তুলতে পারি না। তাই শেষ বয়সে আমাদের গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি লালনপালন এবং অন্যান্য কাজের ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি সরকারসহ সবার কাছে।

অন্য হিজড়াদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, মানুষ সবসময় আমাদের খারাপ চোখে দেখে। আমরা পরিবার, সমাজসহ সব জায়গা থেকে বিতাড়িত। আমাদের কোনো শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ নেই, তাই অফিস-আদালত-কর্মক্ষেত্র নেই।

তারা বলেন, মানুষের কাছ থেকে ওভাবে টাকা তুলতে আমাদেরও ভালো লাগে না। এটা সম্মানজনক কোনো কাজ নয়। কিন্তু আমাদের খেতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনও মেটাতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের এ পথে নামতে হয়।

আশার কথা হলো,যত অর্গলই থাকুক না কেন, সেসব ধীরে ধীরে ভাঙছেন তৃতীয় লিঙ্গের এই জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নবীন প্রজন্ম। এরই মধ্যে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের দুজন প্রার্থী। তারা হলেন : খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শাহিদা বিবি (৩৪) এবং ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ৬নং ত্রিলোচনপুরের নজরুল ইসলাম ঋতু। এছাড়া দেশের ইতিহাসে প্রথম সংবাদ পাঠিকা হিসেবে বেসরকারি টিভি চ্যানেল বৈশাখীতে কাজ করছেন তাসনুভা আনান শিশির। সবার আশা, এভাবেই একসময় দেশের এই জনগোষ্ঠী বোঝা থেকে পরিণত হবেন সম্পদে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App