×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন পাস : ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সরকারের সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০২ এএম

অনেক প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল ২০২২’। এই বিল পাসের মাধ্যমে বিগত ৫০ বছরের একটি শূন্যতা পূরণ হলো বলে আমরা মনে করি। পাস হওয়া এই বিলে কী আছে তা যদি আমরা এক নজরে দেখতে চাই তবে দেখা যাবে- প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নামের তালিকা প্রণয়নের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৬ সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত ২ জন বিশিষ্ট নাগরিক- এই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের একজনকে হতে হবে নারী। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময় নারীর ক্ষমতায়নের যে কথা বলেন তা যে শুধু কথার কথা নয় অনুসন্ধান কমিটিতে একজন নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি সেই যুগান্তকারী ঘটনার প্রকাশ বলেও আমরা মনে করি। সুতরাং বলতেই হবে যে, এরূপ আইনের ফলে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। এই অনুসন্ধান কমিটির কার্যকাল হবে ১৫ কার্যদিবস এবং কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আমরা জানি, নির্বাচন কমিশন আইন এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রত্যাশা। শুধু এ দেশের জনগণই নয় রাজনৈতিক দলগুলোও দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিল। আমাদের মহান সংবিধানেও এরূপ একটি আইন সৃষ্টির তাগিদ ছিল, যা একই সঙ্গে ছিল দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিগত ৫০ বছরে এ আইনটি প্রণয়ন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অবশেষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আবহের মধ্যে হলেও আইনটি প্রণীত হয়েছে, এটিই আশার কথা। এই আইন পাস করাকে তাই ঐতিহাসিক ঘটনা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ এই আইন পাসের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ও আকাক্সক্ষা পূরণ হলো। এ আইন পাসের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রতিবারই আমরা দেখতে পাই নানা রকমের অস্বাস্থ্যকর আলাপ-আলোচনা, বাকবিতণ্ডা এবং রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির চিত্র। রাজনৈতিক মাঠ-ময়দান এবং গণমাধ্যমের প্রধান বিষয় হযে ওঠে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া, কৌশল, কাঠামো প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা। টেলিভিশনের ‘টক-শো’ হয়ে ওঠে পক্ষ-বিপক্ষের কাজিয়া-ফ্যাসাদের কুরুক্ষেত্র! সব আলোচনা-সমালোচনাই যে নিরর্থক থাকে তা নয়। বরং কোনো কোনো সমালোচনার গঠনমূলক দিকনির্দেশনা আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার পটভূমিকেও সমৃদ্ধ করে। সাম্প্রতিককালে আইনটি পাস হওয়ায় গণতন্ত্রেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের পথ অনেকটাই মসৃণ হলো। কিন্তু এই আইন পাসকে যারা ‘তড়িঘড়ি’ হিসেবে নেতিবাচকভাবে দেখতে চান আইনমন্ত্রী তাদের প্রকারান্তরে ২০১২ সাল থেকে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়ার বিষয়টিও সংসদকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার মতে, আইনটি করতে তাড়াহুড়ো করা হয়নি। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয় তখনই আইনের বিষয়ে কথা হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী আইনটি করার কথা বলেছিলেন। আইনমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এই আইন করার প্রক্রিয়া শুরুর পর যারা বাইরে কথা বলেন তাদের আন্দোলন সৃষ্টির চেষ্টার যে টুলস বা মসলা সেটা আর থাকেনি।’ আইনমন্ত্রী আমাদের আরো স্মরণ করিয়ে দেন এই বলে যে, সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রপতির সংলাপে যারা গেছেন কিংবা যারা যাননি- তারা নির্বাচন কমিশন নতুন আইনের মাধ্যমে গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি জোরের সঙ্গে আরো বলেন, ‘আমরা তড়িঘড়ি করিনি। [..] ইসি গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হয়েছিল। তখন থেকেই এই সার্চ কমিটির ধারণা এসেছে। এটা কল্পনা থেকেও আসেনি, আকাশ থেকেও পড়েনি।’ সুতরাং এই বিল পাসের মাধ্যমে দেশবাসী একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পাবে, এটাই সাধারণের প্রত্যাশা। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ। আশা করা যায় জাতীয় সংসদে পাসকৃত বিলটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর দ্রুতই গেজেট আকারে প্রকাশে একটি শক্তিশালী অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হবে। অনুসন্ধান কমিটিও তাদের নির্দিষ্ট কার্যকালে শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে জাতীয় প্রত্যাশা পূরণ করবে। আমরা আসন্ন মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে নবগঠিত সেই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনটি দেখতে পাব। যার জন্য পূর্বেই বলেছি দীর্ঘ ৫০ বছরের অপেক্ষা- সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার একটি সফল অবসান ঘটবে। আশা করা যায় ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সফল নির্বাচন সম্পন্ন করে ইতিহাসের ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার মধুতর ফল’ জনগণ ভোগ করবেন। অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাংলাদেশের গণতন্ত্রচর্চার পথ সুগম হয়ে উঠবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা আর উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। কিন্তু দেশবাসীর প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারের পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। নানা ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংকট থাকে। এসব সংকট কখনো বাস্তবোচিত আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃত্রিমও। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীরা নানা ধরনের সংকট সৃষ্টি করে সরকারকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এমনই কিছু ষড়যন্ত্রের ঘটনায় কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের গণমাধ্যম বেশ সরব! আওয়ামী লীগ টানা তিনবার ক্ষমতায় আছে। পক্ষান্তরে সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিএনপি তাদের সমমনা ও সহযোগী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সহায়তায় দেশের ভেতর এবং বাইরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে বিভিন্ন দালিলিক প্রামাণ্য উত্থাপনের মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ভাষণ দিলেন তখন আমরা বিস্মিত না হয়ে পারিনি! হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নি করে দাললদের (লবিস্ট) মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগকে সরানোর কী গভীর ষড়যন্ত্রেই না তারা লিপ্ত রয়েছে! শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ মিশনে যেখানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর সুনাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেখানে বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে র‌্যাব কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত না করার জন্যও তারা লবিস্ট তথা দালাল নিয়োগ করেছে! এসব লবিস্ট বা দালাল বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের প্রভাবিত করে সংশ্লিষ্ট দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, ঋণসহায়তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে বিএনপি ও জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ প্রভৃতি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানে মানবাধিকার সংগঠনের নাম ও ধ্বজাধারী একাধিক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান বিএনপি-জামায়াতের টাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নেও বাংলাদেশকে সহায়তাদানে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমে বহুল প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনে যেমনটি বলা হয় ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে লুকানো থাকে না কিছুই’- তদ্রƒপ ষড়যন্ত্রও ধামাচাপা থাকে না। কোনো না কোনোভাবে সবকিছুই মানুষের নজরে চলে আসে। সাধারণ মানুষও সহজেই ষড়যন্ত্র বুঝে ফেলে! ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়েও নানারূপ ষড়যন্ত্র আমাদের দেখতে হবে এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়! সাধারণ মানুষ ষড়যন্ত্র নিয়ে কিংবা তা মোকাবিলা করা নিয়ে কতটা মাথা ঘামান তা নির্বাচনের ফলাফলদৃষ্টেই টের পাওয়া যাবে। তবে আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতার শেষ দুই বছরের শুরু থেকেই আমরা নানা রকমের যে ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি তা ভবিষ্যতে হ্রাস পাবে বলে আপাতদৃষ্টে আমাদের মনে হয় না। জাতীয় নির্বাচন যতই নিকটবর্তী হবে বিচিত্র রকমের ষড়যন্ত্র ততই বৃদ্ধি পাবে। আবার ষড়যন্ত্রই যে শুধু বৃদ্ধি পাবে তাও নয়- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী এবং অপপ্রচারকারীরা যে ‘আদা-জল খেয়ে’ লেগে পড়বেন তাও স্পষ্ট। দেশ-বিদেশ থেকে এই ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার সামাজিক মাধ্যমে সয়লাব হয়ে পড়বে! এই অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আওয়ামী লীগকে এখন থেকে সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। একটি প্রশিক্ষিত সংগঠনও আওয়ামী লীগের প্রস্তুত করা প্রয়োজন যারা মূলত একটি বাহিনী হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোদ্ধারূপে সক্রিয় থাকবে। তৃতীয় মেয়াদের শেষ সময়ের দিকে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ ষড়যন্ত্র। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে বাকি দুটি বছর উন্নয়ন ও অগ্রগতির চেয়ে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায়ই বেশি মনোযোগ দিতে হবে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে সতর্কতা ও সূ² কৌশলের ওপরই এই মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App