×

মুক্তচিন্তা

ঠাণ্ডাযুদ্ধের বিশ্ব ধাঁধা : বাংলাদেশও মুক্ত?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০২ এএম

এশীয় অঞ্চলে চীন এবং গোটা বিশ্বের দূরাঞ্চলে উইন্ড খুলে একাকার করে ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র। আশপাশ ছাড়িয়ে দূর-দূরান্তেও থাবা বিস্তারে বিশ্বজুড়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। যে যেদিকে পারছে এগোচ্ছে, নইলে মিত্র বাছাই করছে। গা বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে নিরিবিলি দেশগুলোর জন্য। শক্তিধররাও অবস্থান পাল্টাচ্ছে। হঠাৎ আমেরিকার ইউক্রেন ইস্যুতে গরমভাবের মধ্যে নরমের কৌশলও কম নয়। ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের আগে-পিছেও নানা ঘটনার পরম্পরা। পশ্চিমাদের সামরিক ন্যাটো মিত্ররা নিজেদের সেনাদের সতর্কাবস্থায় রেখেছে এবং পূর্ব ইউরোপে অতিরিক্ত সেনা পাঠাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে- এমন শঙ্কার মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন মেরুতে ঘটছে যত ঘটনাবলি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ইউক্রেন আক্রমণের পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করলেও রাশিয়া তাদের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বেশকিছু দাবি তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। তারা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়ার বিপক্ষে। ফ্রান্সে ২৬ জানুয়ারি চতুর্মুখী বৈঠকে রাশিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের দূতাবাস থেকে পরিবারসহ বসবাসরত কর্মীদের প্রস্থান করার নির্দেশ দিয়েছে এবং রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপের হুমকির কারণে সব নাগরিকের চলে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে। অপরদিকে একই দিনে তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের বিমানবাহিনী অক্টোবরের পর থেকে সবচেয়ে বড় ধরনের অনুপ্রবেশ করেছে। দ্বীপটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে তাইওয়ানের যোদ্ধারা উত্তেজনার সর্বশেষ পর্যায়ে ৩৯টি বিমানকে ঝাঁপিয়ে পড়তে সতর্কাবস্থায় রেখেছে। ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সামরিক উপস্থিতির জবাবে যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে ৮ হাজার সৈন্যকে প্রস্তুত রেখেছে। কাছাকাছি সময়ে মিসরের কাছে বিপুল অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিল বাইডেন প্রশাসন। তাদের কোথাও গণতন্ত্রের জন্য কান্না, কোথাও স্বৈরাচার রক্ষার চেষ্টার ধরন স্নায়ুযুদ্ধের পারদকে নাড়া দিচ্ছে। এ রকম অবস্থায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েপ এরদোয়ান। রুশ প্রেসিডেন্ট তুরস্ক সফরে গেলে তার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে পুতিন আমন্ত্রণ কবুল করেছেন কিনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তথ্য নেই। রাশিয়া থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘এস-৪০০’ কেনা নিয়ে দুদেশের ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বেড়েছে। একই সময়ে এই ইস্যুতে তুরস্কের ওপর মার্কিন চাপ বেড়েছে। বেড়েছে ন্যাটোর চাপও। এর আগে তুরস্ক কিন্তু বলেছে, মার্কিন হুমকি তোয়াক্কা না করে তুরস্ক ‘এস-৪০০’ কেনা অব্যাহত রাখবে। আরো নানা কারণে ঘটনা জট পাকাচ্ছে। কে কোন দিকে ছুটছে? কার সঙ্গে নতুন মিত্রতা পাতছে? কার সঙ্গে পাকাচ্ছে বৈরিতা- কিছুই খোলাসা নয়। বরং প্যাঁচে ভরা। উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি দুটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকার প্রথমবারের মতো দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দুই নৌকায় পা দেয়া দেশগুলোর জন্য সামনে কঠিন সময় আসছে। এর বিপরীতে দুই নৌকায় পা দিয়ে মধ্যম কূটনীতির এ খরার সময়ে তিন নৌকায় পা আরো কোনো কোনো নৌকায় হাত দিয়ে ঝুলে থাকার চাতুরিও কম নয়। এর নেপথ্যে অর্থনৈতিক হিসাবের পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থানও ফ্যাক্টর। ভূ-কৌশলগত কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের সব ভুলে যাওয়া দ্বীপগুলোতে চীনের নজর বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ বাড়ছে। চীনের আশপাশের সবদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশও যার একটি। এখানে হাত নাড়ানোর শক্তির অভাব হচ্ছে না। মানবাধিকার ইস্যুতে সরকার, র‌্যাব এবং পুলিশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউর ভাইস প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখেছেন স্লোভাকিয়ার এমপি ইভান। মালদ্বীপের মতো পুঁচকে দেশও রেহাই পাচ্ছে না এই ধাঁধা থেকে। ভারত মহাসাগরে নীল জলরাশির ১ হাজার ২০০টির মতো ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গড়া দেশটিতেও দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দিন দিন কদর্য চেহারা নিচ্ছে। সেখানে যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। ভারত মহাসাগরে চীনকে রুখতে তার দরকার মালদ্বীপকে। এরই মধ্যে মালদ্বীপের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব যে অশান্তির নতুন খাদে পড়তে যাচ্ছে তা কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-রাশিয়া নয়, তা আরো অনেকের চালচলন-ভাবভঙ্গিতেই স্পষ্ট। তবে আমেরিকা কার সঙ্গে আগে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, রাশিয়া না চীনের সঙ্গে তা এখনো ধাঁধা হয়েই রয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে পরিবর্তনের বাতাসও বইছে। তা যুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, না দেশে দেশে অশান্তি বাড়াবে? অস্ত্রবাণিজ্য বাড়াবে? নাকি আন্ডার হ্যান্ড রিলেশনস বাড়াবে? প্রশ্ন নানামুখী। এই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে ভেঙে খান খান করে ইউরোপকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এবার দৃষ্টি চীন, জাপান, কোরিয়ার দিকে। আফগানিস্তানে পরাজয় মেনে নিয়ে তালেবানদের কাছে কেন ক্ষমতা ছেড়ে চম্পট দিয়েছে তা নিয়ে গবেষণার সিরিজ চলছে। তারা মানবাধিকার-ভোটাধিকারের কথা বলছে। আবার আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকে, প্যালেস্টাইনকে যা করার করেছে। চীন, জাপান, কোরিয়াকে কী করতে চায় একেবারে না বোঝার মতো বিষয় নয়। গত ৩০ বছরে ইউরোপের দেশগুলো স্নায়ুযুদ্ধের দামামা দেখেনি। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সপ্তাহে কূটনৈতিক কথাবার্তার তৃতীয় রাউন্ডের সময় সতর্ক করেছিলেন রাশিয়া ইউক্রেনকে কখনই ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে সম্মত হবে না। এজন্য অনুমতিও রাশিয়া কখনো দেবে না। এ উত্তেজনা প্রশমন না হলে সামনে কী হতে পারে ইউরোপের ভবিষ্যৎ? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। স্মরণ করতেই হয় ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে এবং ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করে। যুদ্ধ কীভাবে বাধে সেই অভিজ্ঞতা ইউরোপের আছে, পোল্যান্ডেরও আছে। ছোট দেশগুলো পড়েছে বিপদে। দেশ ছোট হলেও জাতিসংঘে ভোট দেয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। এ কারণে পরাশক্তিগুলো ছোট দেশলোকেও কাছে টানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। নিরপেক্ষ বা গা বাঁচানোর বা সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পার পাওয়ার দিন আর নেই। পরাশক্তিগুলোর ঠোকাঠুকির জের কেবল পরাশক্তিগুলোর কাছেই থাকলে হিসাব ভিন্ন হতো। কিন্তু বাস্তবতা সেখানে নেই। বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। আগের অনেক হিসাবই মিলছে না। স্বার্থসহ লাভ-লোকসানের অঙ্কও আগের মতো নেই। এর পরিণামে পরাশক্তিগুলোর এই প্রতিযোগিতার ফল-কুফল বহুমাত্রিক। আরামে বা গা বাছিয়ে উভয় নৌকায় পা রেখে চলার দেশগুলোর সরকার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। যেমনটি হয়েছিল গত শীতল যুদ্ধের সময়। ধাঁধার কিছু জবাব মেলে এই পরিবর্তনে। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App