×

মুক্তচিন্তা

কিমাশ্চর্যম অতঃপরম

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০১:২৫ এএম

লেখার বিষয়ের অন্ত নেই। প্রতিদিন টেলিভিশনে দেশি-বিদেশি চ্যানেলগুলো দেখলে তা চোখে ধরা পড়ে। কিন্তু চ্যানেলগুলো তো শুধুই হেডলাইন প্রচার করে। তাই অপেক্ষা করতে হয় পরদিন সংবাদপত্র পাওয়ার জন্য। আজ যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি তা নিয়ে এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে, কী সংবাদপত্রগুলোতে, কী অনলাইন প্রচার মাধ্যমগুলোতে, কী চায়ের দোকানে, অফিস-আদালতে আলোচনার বিষয়বস্তু। আর যাকে নিয়ে এই ঝড়টি উঠেছে তার ছবি সর্বাধিক প্রাধান্য পাওয়ায় তিনি দেশ-বিদেশে এখন সর্বাধিক পরিচিতদের মধ্যে একজন অন্তত এই মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে। যার কথা বলছি তিনি ডা. মুরাদ হাসান। কয়েক বছর ধরে তিনি আমাদের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। একজন সংসদ সদস্যও। মন্ত্রিসভার প্রধান বা গোটা সরকার নারী-বান্ধব অন্তত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মধ্যে তা দেশ-বিদেশে স্বীকৃত। যদিও নারী সমাজের বহু গুরুত্বপূর্ণ দাবি-দাওয়া আজো পূরণের অপেক্ষায়। এহেন সরকারের মন্ত্রিসভায় দিব্যি স্থান করে নিয়েছিলেন মুরাদ। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার নামে ও জয় বাংলা বা বাংলাদেশ চিরজীবী হোক বলতে কদাপি ক্লান্তিবোধ করেননি। কিন্তু কী দিয়ে কী হলো তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। নানা সংবাদ মাধ্যমে অজ¯্র নারীকে নিয়ে নানা অবাঞ্ছিত, অনাকাক্সিক্ষত, অশ্লীল অশ্রাব্য কথা বলায়- ভিডিও ক্লিপে ধারণ ও প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তা ভাইরাল হয়। জনমত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মুরাদের বিরুদ্ধে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক- তাকে পদচ্যুত করা হোক- প্রচলিত নানা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হোক- এমন দাবি ক্রমান্বয়েই জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন পদচ্যুত না করে। সবাই জানি পদচ্যুত করার স্পষ্ট অর্থ হলো শাস্তি প্রদান করা আর পদত্যাগ নানাবিধ হতে পারে। যেমন অবস্থার চাপে, বা স্বেচ্ছায় বা শিগগিরই অন্য পদে নিয়োগ দেয়ার কারণে বা অধিকতর যোগ্য কাউকে ওই পদে অধিষ্ঠিত করার জন্য। এর যে কোনোটাই হতে পারে। যা হোক পদত্যাগ পত্রে মুরাদ লিখলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করলাম। যদি এটাকে শাস্তি বলি তবে মানতেই হবে, এটা মৃদু বা নরম একটি শাস্তি।’ যা হোক, সবাই মেনে নিয়েছেন এবং মুরাদের পরবর্তী আচরণে বোঝা যায়, তাকে শাস্তিই দেয়া হয়েছে। এজন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমিটি (আওয়ামী লীগের) ডা. মুরাদকে সাংগঠনিক সব পদ থেকে অবসর দিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করেছেন, মুরাদকে দলীয় সদস্যপদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে দেয়া হোক। তবে এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়নি, ফলে তার বিষয়টি আলোচনাও হয়নি। তাই নিম্নতর কমিটিগুলোর সম্মিলিত দাবি পূরণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ তার রয়েই গেছে, সেটি হলো সংসদ সদস্য পদ। যার মেয়াদ আরো দুই বছর বিদ্যমান আছে। এই পদ থেকে পদত্যাগ করতে তাকে বলা হয়নি। তাকে যদি সংসদে না চাওয়া হয় অর্থাৎ সংসদ সদস্য পদে যদি তিনি অনাকাক্সিক্ষত হন তবে তাকে অপসারিত করতে হবে। সে পথ জটিল। আমাদের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, যদি কোনো সদস্য পার্টির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট প্রদান করেন তখন সংসদ স্পিকারকে বলতে পারেন তাকে অপসারণ করা হোক এবং স্পিকার তা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঘটনা অর্থাৎ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটেনি- তাই অপসারণের কোনো সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। আর একটি পথ আছে। তা হলো তিনি যদি একাধিক্রমে সংসদের অধিবেশন চলাকালীন ৯০টি দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকেন তবে তার সদস্যপদ থাকবে না এবং ওই কারণে তিনি আর সংসদ সদস্য নন বলে স্পিকার ঘোষণা দেবেন। দিল্লি বহুত দূর-অস্ত। কারণ বর্তমান সংসদের মেয়াদকালের আয়ু যতটুকু বাকি তাতে ৯০ দিন অধিবেশন বসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। করোনা-ওমিক্রন বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা- এ সবই লম্বা অধিবেশনের বিপরীতে। তাই ধরেই নেয়া যায় ডা. মুরাদের সংসদ সদস্য পদ বর্তমান মেয়াদে বহাল থাকছে অন্তত তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যদি পদত্যাগ না করেন। বাংলাদেশ সরকার তার বিরুদ্ধে কঠোর হতে না চাইলেও বিদেশিরা দিব্যি দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। বিদেশ-যাত্রা এবং ফিরতি যাত্রা ও ফেরত আমার এসব কাহিনী পড়ে তা দিব্যি উপলব্ধি করা যায়। পদত্যাগ করার দুদিন পরে রাতের আঁধারে তিনি রওনা দিলেন বিদেশের উদ্দেশে, তবে একা। পরিবার পরিজনকে নিয়ে নয়। রওনা হলেন কানাডা- সেখানে পৌঁছার পর তিনি পড়লেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরের পালায়। অবশেষে ওই বাহিনী তাকে সংসদ সদস্য এবং লাল পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও ঢুকতে দিলেন না। ডা. মুরাদ এবার রওনা হলেন দুবাইয়ের উদ্দেশে। না, সেখানেও যেতে পারলেন না। ফিরতে হলো দেশে রাতের অন্ধকারে, তাও আবার ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে নয়। কারণ সেখানে অনেক সাংবাদিক তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই গতি পরিবর্তন করে সাধারণ পথ দিয়ে কালো কাপড়ে মাথার টাক ঢেকে সেখানে অপেক্ষমাণ এক গাড়িতে চলে গেলেন। ডা. মুরাদের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন কী? না, ঢাকা শহরে তিন তিনটি বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তার কোনোখানেই তিনি ওঠেননি। তার বাড়ির দারোয়ানরা জানেন না, তার স্ত্রী সন্তানরাও জানেন না। তবে তিনি কি আত্মগোপনে গেলেন? তাতো হওয়ার কথা না। কার ভয়ে তবে বাসায় গেলেন না? স্ত্রী সন্তানদের? তবে কি তিনি তালাকের মুখোমুখি হতে চলেছেন? সন্দেহটা করছি এ কারণে যে, তিনি যা করেছেন তা কোনো স্ত্রী বা সন্তানরা কদাপি গ্রহণ করেন না? মামলা নয় কেন? লিখিতভাবে না হলেও নারীঘটিত ব্যাপারে ডা. মুরাদকে পদত্যাগ করতে সরকারিভাবেই বলা হয়েছিল। তা করায় ডা. মুরাদ ওই অভিযোগগুলো স্বীকার করে নিয়েছেন। অন্তত পদত্যাগ তাই প্রমাণ করে। তাহলে এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হাজার হাজার ঘটনা ঘটলেই যেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে, হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন থাকছে আবার বহু মামলায় ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে- সেখানে ডা. মুরাদ এমপির বিরুদ্ধে সরকারিভাবে তা নেয়া হচ্ছে না কেন? এই দাবি বাংলাদেশের নারী সমাজের, বাংলাদেশের সব সুস্থ চিন্তার নাগরিকের। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ নেই কেন? ডা. মুরাদ অসংখ্য নারীকে উত্ত্যক্ত করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অনেক নেত্রীকে নানাভাবে নির্যাতন করেছেন। একজন মহিলাকে পুলিশ দিয়ে এক হোটেলে আনবেন যদি নিজে থেকে মহিলাটি না আসেন বলে হুমকি দিয়েছেন। অপর এক মহিলার সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপ যেভাবে ফাঁস হয়েছে তার প্রতিটি ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এক বা একাধিক মোকদ্দমা হতে পারে। জনগণের দাবিও তাই। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয়, ছলিমুদ্দি-কলিমুদ্দিরা কেউ এর সিকি পরিমাণ অপরাধ করলে অনেক আগেই জেলে যেতে বাধ্য হতেন- ডা. মুরাদ বলেই কি তা হচ্ছেন না? আইনের শাসনের এবং নারীবান্ধবে এই দেশে আইন প্রয়োগে এমন বৈষম্য কেন? এতে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না তাই বলি, কিমাশ্চর্যম অতঃপরম। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App