×

জাতীয়

বৈধ লবিস্টের প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবহার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৯ এএম

বৈধ লবিস্টের প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবহার

বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির

বিএনপি-আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের

বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে বিএনপি-জামায়াত চক্র বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলে ওঠা পুরনো অভিযোগ সাম্প্রতিককালে আবারো জোরালো হয়েছে। লবিস্ট নিয়োগের পাল্টা অভিযোগ উঠেছে খোদ সরকারের বিরুদ্ধেও। বিষয়টি এখন সংসদ থেকে শুরু করে রাজনীতির হাটে-মাঠে আলোচনার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবিস্ট নিয়োগ অবৈধ নয়। অনেক দেশেই বৈধ লবিস্ট ফার্ম রয়েছে। কিন্তু লবিস্টরা যদি কোনো দেশের বিরুদ্ধে বা সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়, সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের লবিস্ট নিয়োগকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

গত ১০ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন তখন গণমাধ্যমে বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে যেভাবে প্রয়োজন তদবির করা হবে। গত ১৮ জানুয়ারি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিএনপির প্রতি অভিযোগ এনে জাতীয় সংসদে বলেন, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে।

১৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন আরো বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এবং রাস্কি পার্টনারস নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিল বিএনপি। সরকারবিরোধী প্রচারের জন্য লবিস্ট ফার্মকে দলটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা সাড়ে ৩১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর বিপরীতে সরকার কোনো লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে কিনা, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সরকার বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেনি। তবে জনসংযোগের জন্য পিআর ফার্ম নিয়োগ করেছে। এজন্য প্রতি মাসে সরকারকে ২৫ হাজার ডলার দিতে হচ্ছে।

শাহরিয়ার আলমের এ বক্তব্যের পর বিষয়টি জোরালো আলোচনায় পরিণত হয়। ওই দিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জনগণের টাকায় নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সরকার ১৪ বছর ধরে লবিস্ট নিয়োগ করে চলছে। আর সেটা আড়াল করতে বিএনপির বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগের কল্পকাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের প্রথম লবিস্ট অ্যালক্যাডে এন্ড ফোকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০০৪ সালের ২৯ নভেম্বর। যা কার্যকর হয় ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি। এই লবিস্ট ফার্মকে চুক্তি অনুযায়ী মাসে ৩০ হাজার ডলার হিসেবে সাড়ে ১২ লাখ ডলার অর্থাৎ ১০ কোটির বেশি টাকা দেয়া হয়। এসব বিষয়ে চলতি অধিবেশনে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা ও জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত বক্তব্য দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এমরান হুসাইন বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফার্ম বা ব্যক্তি রয়েছে যারা বৈধভাবে লবিংয়ের কাজ করে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, জনমত তৈরিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন গোষ্ঠী (ব্যবসায়ী, সরকার বা বিরোধী দলও হতে পারে) এদের নিয়োগ করে। বাংলাদেশে যে বিতর্কটা দেখা দিয়েছে সেটা হলো, এক পক্ষ বলছে এটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। অন্যপক্ষ বলছে, জনগণের টাকা খরচ করে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা। তিনি বলেন, যদি কোনো দেশের সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়, গুম-খুন, দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, তবে সংক্ষুব্ধরা কারো না কারো কাছে নালিশ জানাতেই পারেন। এজন্য লবিস্ট নিয়োগ অবৈধ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যদি সেটি হয় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র, তবে তা আমলে নিতে হবে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অযথা বিতর্কে মাঠ গরম না করে তথ্যপ্রমাণসহ সবার কথা বলা উচিত।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকতে এবং বিএনপির ক্ষমতায় যেতে লবিস্ট প্রয়োজন পড়ছে। এই রেষারেষিতে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু করের টাকার অপব্যবহার না হলেই হলো।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা শোনা যায় ১৯৯১ সালে। ১৯৯০ এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের দুর্নীতি তদন্তের জোরালো দাবি ওঠে। সে সময় এরশাদের কথিত পাচার করা ১০ বিলিয়ন ডলার খুঁজে বের করতে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ফেয়ার ফ্যাক্সকে নিয়োগ দেয় তৎকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তবে শেষ পর্যন্ত ওই টাকার হদিস দিতে পারেনি সংস্থাটি।

বিভিন্ন মাধ্যমের খবরে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের দুটি লবিং ফার্মকে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের বিনিময়ে নিয়োগ দেয় বিএনপি। বিএনপি এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টের শরণাপন্ন হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে জামায়াতে ইসলামীও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। এছাড়া নিজেদের প্রচার ও সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগও লবিংয়ের পথে গেছে। তবে এসব ব্যয়ের বিষয়ে প্রায় সবাই গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের (ফারা) আওতায় অনলাইনে প্রকাশিত নথি থেকে দেখা যায়, ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ অ্যালক্যাড অ্যান্ড ফে নামের লবিং প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১২ লাখ ডলারের বেশি পরিশোধ করে। প্রকাশিত চুক্তির শর্তে দেখা যায়, তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের নীতিগুলোর অন্তর্নিহিত বিপদ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচির কল্যাণকর দিকগুলো তুলে ধরে সমর্থন আদায় ছিল এর মূল লক্ষ্য।

অন্যদিকে বিএনপির পক্ষে লন্ডনপ্রবাসী আবদুস সাত্তার ২০১৮ সালে ব্লæস্টার স্ট্র্যাটেজিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট নিয়োগ দেন। এজন্য ৫৫ হাজার ডলারের চুক্তি হয়। ওই নথিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাংলাদেশের নির্বাচনে বিএনপির লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপির স্বার্থের বিষয়টি নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যমে তুলে ধরা এবং সরকারগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার কৌশল নির্ধারণ করার কথা ছিল লবিস্ট গ্রুপের।

এছাড়া করভিস কমিউনিকেশনস, এলএলসির জমা দেয়া বিবরণী অনুযায়ী, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র শাখার পক্ষে ডন হক নামের এক ব্যক্তি ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে শুধু একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ২০১৫ সালেও বিএনপির পক্ষে ব্রিটিশ আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যান যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকিনগাম্প স্ট্রস হাওয়ার অ্যান্ড ফেল্ড এলএলপির সঙ্গে একটি চুক্তির খসড়া করেন। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার শেষ বছরেও ২০০৫ সালে কেচাম ওয়াশিংটন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। তখন দেয়া হয় ১ লাখ ডলার বা ৮০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার এবং আইনগত ত্রæটির প্রশ্ন তুলে লবিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছরে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস নামের একটি সংগঠন। যার পেছনে বেনামে ছিল জামায়াতে ইসলাম। চুক্তির নথিতে বলা হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারের প্রভাবাধীন ট্রাইব্যুনালে দলীয় সদস্যদের বিচার ঠেকানো। অর্গানাইজেশন ফর পিস এন্ড জাস্টিস মূলত মানবতাবিরোধী আদালতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে জনমত তৈরি ও রাজনীতিকদের প্রভাবিত করার লক্ষ্যেই পেশাদার লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগায়।

জঙ্গি অর্থায়নে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসির ভূমিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটের তদন্তে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকের নাম আসার পর ইসলামী ব্যাংকও সেখানে লবিস্ট নিয়োগ করে। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি ডানা কনট্রাটো এবং পাওয়েল মুরকে নিয়োগ করে যথাক্রমে ১ লাখ ২০ হাজার এবং ৪৫ হাজার ডলারে। ২০১৫ সালে ইসলামী ব্যাংক নিয়োগ করে পডেস্টা গ্রুপকে এবং মোট প্রায় ৩ লাখ ডলার খরচ করে। ২০১৬ সালেও প্রথম চার মাস পডেস্টা গ্রুপের সেবা নেয় ব্যাংকটি। যার জন্য পরিশোধ করা হয় ৯০ হাজার ডলার বা ৭২ লাখ টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App