×

সারাদেশ

সাফারি পার্কে ৯ জেব্রার মৃত্যু, খতিয়ে দেখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:২০ পিএম

সাফারি পার্কে ৯ জেব্রার মৃত্যু, খতিয়ে দেখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

গাজীপুরের শ্রীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ২২ দিনে ১১ জেব্রা মারা গেছে। ফাইল ছবি

গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ২২ দিনে নয়টি জেব্রার মৃত্যুর ঘটনার বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন।

একনেকের বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। মন্ত্রী বলেন, আমি বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে জেব্রার মৃত্যুর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সংশ্লিষ্টদের তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। তারা বলেছে অজ্ঞাত ভাইরাসের আক্রমণে এটি হয়েছে। আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।

মঙ্গলবার সকালে সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির বলেন, গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে জেব্রাগুলো মারা গেছে। মৃত জেব্রাগুলোর ময়নাতদন্তের সব প্রতিবেদন হাতে আসার পর আজ সাফারি পার্কে জরুরি বৈঠকে বসেছেন বিশেষজ্ঞদল। বিকেলে এ ব্যাপারে জানানো হবে।

২ জানুয়ারি থেকে পার্কে জেব্রার মৃত্যু শুরু হলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গোপন রেখেছিল। সোমবার সন্ধ্যার পর বিষয়টি প্রকাশ পায়।

এক অনুসন্ধানে বিষক্রিয়ায় জেব্রার মৃত্যুর তথ্য প্রমাণ থাকায় তাদের হত্যা করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্ন ঘনীভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এটাকে পরিকল্পিত হত্যা বলে আশঙ্কা করছেন। তবে অপরাধীদের রক্ষায় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কাছে পরীক্ষার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে স্যাম্পল না পাঠিয়ে জেব্রা হত্যাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক মো. তবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, জেব্রার মৃতদেহের নমুনা রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। সোমবার রাতে সবগুলোর ফলাফলও হাতে পেয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সাফারি পার্কে সর্বশেষ ৩১টি জেব্রা ছিল। নয়টি জেব্রা মৃত্যুর পর এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১টিতে। এর আগে অল্প সময়ে এ পার্কে এতোগুলো প্রাণী আর কখনও মারা যায়নি বলে জানান তবিবুর।

পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সকালে শুরু হওয়া বৈঠকটি দুপুর ১টা পর্যন্ত চলছিল। বৈঠকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেনারি অনুষদের তিনজন বিশেষজ্ঞ, ঢাকা চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর মো. শহিদুল্ল্যাহ ও গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল আরও জানান, খাদ্যে বিষক্রিয়া, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণসহ নানা কারণে জেব্রাগুলোর মৃত্যু হতে পারে।

তিনি বলেন, জেব্রা দলবেঁধে চলে। আগে থেকে এদের মধ্যে কোনো রোগের উপসর্গ দেখা যায় না। জেব্রাগুলো বন্য হওয়ায় এদের কাছেও যাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ তারা দল থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং পেট ফুলে গিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে থাকে। এক সময় মারা যায়।

করোনা ভাইরাস সন্দেহে পিসিআর ল্যাবে মৃত জেব্রাগুলোর নমুনা পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়, কিন্তু সবগুলোর রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে বলেও জানান জাহিদুল।

তিনি বলেন, এ ছাড়া খাবারে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে এমন সন্দেহে খাবারগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। মৃত জেব্রাগুলোর ফুসফুস, লিভার, মৃত্যুর পর পেটে থাকা অর্ধগলিত খাবার পরীক্ষা করা হয়েছে।

তবে জেব্রা ও তা পার্কে থাকা অন্যান্য প্রাণীগুলো একই খাবার খাচ্ছে। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় জেব্রার মৃত্যু হলে অন্যান্য প্রাণীগুলোরও মৃত্যু হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যুর প্রমাণ মিলেনি।

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে ৯০ ভাগই মাদি। এই পার্কে জন্ম নেয়া জেব্রাগুলোর মৃত্যু বেশি হয়েছে।

পার্কের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই বলে জানান জাহিদুল। তিনি বলেন, বাইরে থেকে কেউ গিয়ে বিষ প্রয়োগের সুযোগও নেই। সব বিষয় মাথায় রেখে মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা চলছে।

এদিকে একাধিক সুস্থ সবল জেব্রা মারা যাওয়ায় অভিযোগ উঠে কর্তৃপক্ষের কেউ ঘটনা কৌশলে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে কী না। এরপরই সেখানকার চিকিৎসক ডা. জুলকার নাইনের নেতৃত্বে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আইইডিসিআরসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে স্যাম্পল পাঠানো হয়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষার ফল আসলেও সেই ফল প্রকাশ না করার অভিযোগ তুলেছেন সাফারি পার্কের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারি।

অন্যদিকে প্রথম দিনের ঘটনা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলমান থাকার মধ্যেই একের পর এক জেব্রা অসুস্থ হতে থাকে। এতে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলেও বাইরে কোনো তথ্য প্রকাশ না করার কৌশল নেয়া হয়। ফলে একের পর এক মৃত্যু হলেও গণমাধ্যমসহ কোনো মাধ্যমেই এখন পর্যন্ত তথ্য আসেনি। যদিও ভেতরে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যাপক চেষ্টা চলছে।

নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মচারী বলেন, ঘটনার শুরু হয় ২ জানুয়ারি। সেদিন এক সঙ্গে কয়েকটা জেব্রা মারা যাওয়ার পর থেকে স্যাররা আমাদের ডেকে সব দিকে ভালোভাবে নজর রাখতে বলেছেন। শুক্রবার পর্যন্ত ৯টি জেব্রা মারা গেছে। মাঝে আরও কয়েকটা জেব্রা অসুস্থ হলেও চিকিৎসায় সেগুলো সুস্থ হয়েছে।

এদিকে পরীক্ষা নিরীক্ষায় কি তথ্য মিলছে তা কেউ বলতে রাজি হচ্ছেন না। প্রত্যেক কর্মকর্তার একটাই কথা, আমরা ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণের খবরই পাচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই জেব্রার মৃত্যুর পেছনে বিষক্রিয়ার প্রমাণ মিলেছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের তিন জন বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যমকে বলেছেন, কর্তৃপক্ষ কি বলছে জানিনা। তবে আমরা প্রথমবারের মতো সাফারি পার্কে কোনো প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিষক্রিয়ার প্রমাণ পেয়েছি। কেবল ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো জীবাণু নয়। এখন এই বিষ কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে তা তদন্তের বিষয়। তবে মৃত্যু স্বাভাবিক নয় বলেই মনে করছি।

এদিকে এরই মধ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সঠিক উপায়ে স্যাম্পল পাঠানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সঠিক পদ্ধতিতে স্যাম্পল না পাঠানোকে মৃত্যু রহস্য লুকানোর চেষ্টা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা ঘটনার পেছনে ভেতরের কোনো অপরাধী চক্রের হাত থাকতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, তারাই কৌশলে নাম কাওয়াস্তে স্যাম্পল পাঠাচ্ছে। সঠিক পদ্ধতিতে না পাঠানোয় এরই মধ্যে স্যাম্পল ফিরিয়ে দিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান।

গত সপ্তাহে সাফারি পার্কে গিয়েছিলেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব। তাকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলেছেন, মন্ত্রণালয়কে সকল তথ্য জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সচিবের সঙ্গে মুঠোফোনে কল ও এসএমএসের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। সাফারি পার্কের চিকিৎসক ডা. জুলকার নাইনের সঙ্গে মৃত্যু ও ভুলভাবে স্যাম্পল পাঠানোর বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো ধরনের কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কথা বলবেন।

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেব্রা মৃত্যুর কথা স্বীকার করে বলেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্যাম্পল পাঠিয়েছি। বিশেষজ্ঞরাও এখানে এসেছেন।

মৃত্যুর কারণ নিয়ে অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য জীবাণুর আক্রমণ বলেই এখন পর্যন্ত জানা গেছে। আরও পরীক্ষা চলছে। ২৫ তারিখ আরও অগ্রগতি হবে আশা করি। সচিব স্যার এসেছিলেন তাকেও সব অবগত করা হয়েছে। তবে সঠিক পদ্ধতিতে স্যাম্পল না পাঠানো এবং স্যাম্পল ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App