হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৫ এএম
ছবি : ভোরের কাগজ
কাশি, হালকা জ্বর ও শরীর ব্যথায় গত তিন দিন ধরে ভুগছেন ষাটোর্ধ্ব সাদেকুল হক। বাবা সাদেকুলকে নিয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন মেয়ে সুমাইয়া হক। সুমাইয়া বলেন, টিভিতে দেখেছি বাসাবোতে করোনা ও ওমিক্রনের সংক্রমণ বেশি। আমরা বাসাবোতে থাকি। ওমিক্রনের ক্ষেত্রে যেসব উপসর্গ রয়েছে তা গত তিন দিন ধরে বাবার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। তাই নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছি। সেই সঙ্গে আমার নমুনাও পরীক্ষা করাব। সকাল থেকে নমুনা পরীক্ষার জন্য সিরিয়ালে দাঁড়িয়েছি। এখন অপেক্ষা করছি।
মহাখালীতেও ওমিক্রনের সংক্রমণ বেশি এমন তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। উপসর্গ থাকায় মহাখালী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছিলেন জাহিদুল রহমান ও সুলতানা রহমান দম্পতি। পেশায় দুজনই ব্যাংকার। বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত এই দম্পতি জানান, তাদের দুজনের অফিসেই অনেকে করোনায় আক্রান্ত। এছাড়া তাদের নিজেদের মধ্যেও ওমিক্রমের কিছু উপসর্গ দেখা গেছে। তাই নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন।
রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল, মুগদা হাসপাতাল, ডিএনসিসি হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, পরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের ভিড় রয়েছে। অপেক্ষমাণ ব্যক্তিরা জানান, সবারই রয়েছে উপসর্গ। নমুনা পরীক্ষার কাজের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার জন্য আসা ব্যক্তিদের উপস্থিতি অনেক কম ছিল। ডিসেম্বরের শেষের দিক থেকে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। উপসর্গ দেখা দিলে এখন অনেকেই নমুনা পরীক্ষা করাতে আসছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে করোনা পরীক্ষা শুরু হয়। চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত।
দেশে করোনা সংক্রমণের গ্রাফ উপরের দিকে উঠতে থাকে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই। করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ দেশে শনাক্ত হওয়ার পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ওমিক্রন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মাত্র ৩ সপ্তাহের মধ্যে দৈনিক শনাক্তের হার ডেল্টার সময় যে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার ছিল তার কাছাকাছি পৌঁছেছে। সংক্রমণ বাড়ায় রোগীশূন্য হাসপাতালগুলোতে ধীরে ধীরে বাড়ছে রোগীর চাপ। শ্বাসকষ্ট, খুশখুশে কাশি, জ্বর, শরীর ব্যথাসহ বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর বেশির ভাগেরই করোনা শনাক্ত হচ্ছে।
এদিকে শীত মৌসুমে ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্তের বিষয়টি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া এ ধরনের রোগীদের করোনা নমুনা পরীক্ষা করালেই তারা করোনায় সংক্রমিত বলে রিপোর্ট আসছে। এ কারণে অনেকের মধ্যেই নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনীহাও রয়েছে।
এদিকে গতকাল রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ওমিক্রনের লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে বলেন, ওমিক্রনের যে উপসর্গগুলো আছে, তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নাক দিয়ে পানি ঝরছে। মাথাব্যথা করছে ৬৮ শতাংশ রোগীর। অবসন্নতা ও ক্লান্তি অনুভব করছেন ৬৪ শতাংশ রোগী। হাঁচি দিচ্ছেন ৬০ শতাংশ রোগী। গলাব্যথা হচ্ছে ৬০ শতাংশ রোগীর, কাশি দিচ্ছেন ৪৪ শতাংশ রোগী। নাজমুল ইসলাম বলেন, এই বিষয়গুলো কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এর সঙ্গে সিজনাল ফ্লু হচ্ছে তারও মিল রয়েছে। কাজেই যে কোনো পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই আমাদের চিকিৎসা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সাধারণ বেড আছে ১৩ হাজার ৪১৫টি। খালি আছে ১১ হাজার ১৫৮টি। ১ হাজার ২৫১টি আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) বেডের মধ্যে খালি আছে ৯৭৫টি। এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) ৭০৮টির মধ্যে ৫৮৩টি খালি। ঢাকা বিভাগের ১৫টি সরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার ১৬২টি সাধারণ বেডের মধ্যে ২ হাজার ১৪৬টি খালি। ৩৭৬টি আইসিইউর মধ্যে ২৮৮টি খালি। ৪২৩টি এইচডিইউর মধ্যে খালি ৩২২টি। ৩২টি বেসরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ৫৯৯টি সাধারণ বেডের মধ্যে ১ হাজার ২৪৯টি খালি। ৪১৬টি আইসিইউর মধ্যে ৩৩৫টি খালি ১০২টি এইচডিইউর মধ্যে খালি ৯৮টি। চট্টগ্রামে ৪টি সরকারি ও ৬টি বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ বেড আছে ৯১৭টি। খালি আছে ৬৮৭টি। ৬৪টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৪১টি আর ১৬টি এইচডিইউর মধ্যে ১০টিই খালি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, গত ২ সপ্তাহে তার হাসপাতালের করোনা ইউনিটে রোগী ভর্তির হার ৫ শতাংশ বেড়েছে। আইসিইউতে রোগী তুলনামূলক কম হলেও এইচডিইউতে চাপ বাড়ছে। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সিহাব উদ্দিনও জানান, গত ২ সপ্তাহের মধ্যে এ হাসপাতালে ৩০ শতাংশের বেশি রোগী বেড়েছে। মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামানও জানালেন একই কথা। তিনি জানান, হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি বাড়ছে। এছাড়া করোনা নমুনা পরীক্ষার হারও বেড়েছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে করোনা ডেডিকেটেড বুথ চালু করা হয়েছে। সেখানে টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থাও আছে। বিহির্বিভাগে জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশিসহ করোনার নানা উপসর্গ নিয়ে রোগী আসছেন। করোনা পজিটিভ হলে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. মনোয়ার হাসানাত খান জানান, গত দুই সপ্তাহের তুলনায় এই হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কিছুটা বেড়েছে।
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম গতকাল বলেন, ধীরে ধীরে ডেল্টা ধরনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ওমিক্রন। রোগীর সংখ্যা যদি প্রতিদিনই বাড়তে থাকে এবং স্বাস্থ্যবিধিকে অমান্য করে- তাহলে রোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে। যা সামগ্রিকভাবে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে- গত ৩/৪ মাসের চেয়ে হাসপাতালে রোগী অনেক বেড়েছে এবং এটি অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে এক-তৃতীয়াংশ বেডেই রোগী ভর্তি আছে। রোগী এভাবে বাড়তে থাকলে দেখা যাবে ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে আর কোনো বেড খালি নেই।
আর হাসপাতালের প্রস্তুতি কতটা- এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা জানান, ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও শনাক্তের তুলনায় তা এখনো অনেক কম। তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেন্ট্রাল অক্সিজেন, সাধারণ শয্যা, আইসিইউ, এইচডিইউ সবই রয়েছে। ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতাল এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফিল্ড হাসপাতাল চালু আছে।