×

মুক্তচিন্তা

ডিসি সম্মেলন : শিক্ষা উন্নয়নে প্রশাসনের পদক্ষেপ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৩১ এএম

ডিসি সম্মেলন : শিক্ষা উন্নয়নে প্রশাসনের পদক্ষেপ

১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। করোনা মহামারির কারণে দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হলো এই সম্মেলন। এবার ২১টি কার্য অধিবেশনসহ মোট ২৫টি অধিবেশন ছিল। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনাসামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য সাধারণত প্রতি বছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। কার্য অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকেন। এবার জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছ থেকে ২৬৩টি প্রস্তাব পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি-সংখ্যক প্রস্তাব এসেছে ভূমি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত। এ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত প্রস্তাব এসেছে ১৮টি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, যার প্রস্তাব ছিল ১৬টি এবং তৃতীয়ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত ১৫টি প্রস্তাব। প্রতিটি জেলাকে এক একটি প্রদেশের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় আমাদের জেলা প্রশাসকরা এক ধরনের গভর্নর। তারা জনপ্রতিনিধি নন, অথচ পুরো জেলার সবকিছুর জন্য তাদের ওপর নির্ভর করা হয়। সরকারের গৃহীত সব ধরনের পদক্ষেপসমূহ তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। ব্রিটিশরাজ প্রবর্তিত এই প্রথা দুইশ বছরের অধিককাল ধরে টিকে আছে, শুধু টিকে নেই যেন আরো জোরদার হয়েছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল একজন জনপ্রতিনিধি একটি জেলার সার্বিক কল্যাণের দায়িত্বে থাকবেন আর একজন ডিসি তার সহকর্মীদের নিয়ে সেই সিদ্ধান্তসমূহ রাষ্ট্রপ্রদত্ত অন্যান্য সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু আমরা তা পারিনি। কারণ একজন জনপ্রতিনিধি হয়তো একটি পার্টি থেকে নির্বাচিত হবেন। তার নির্বাচিত হওয়ার পর বাকিদের উন্নয়ন তো দূরের কথা, সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই হয় কঠিন। তাই ব্রিটিশ প্রবর্তিত এই সিদ্ধান্তের ওপরই আমাদের আস্থা রাখতে হচ্ছে। নতুন কিছু আমরা করতেই পারলাম না। আমলাতন্ত্র যদি শক্তিশালী হয় তাহলে জনগণের রাষ্ট্র থেকে সেবা পেতে কষ্ট হয় কিন্তু তাতে দুর্নীতির সুযোগ কম থাকে। যেমন আমলাতন্ত্রের মূল আলয় হচ্ছে সচিবালয়। সেখানে পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের পর পরও সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত ও কঠিন। সেই সচিবালয়ের সিদ্ধান্তকে অনেক ভয় করা হতো। নিয়মের মাধ্যমে যেতে হতো, নিয়মের বাইরে কোনো কিছু করতে সবাই ওই জায়গাটাকে ভয় পেত। তাই যুগে যুগে আমলাতন্ত্রকে ঢিলা করার জন্য, হালকা করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাবান করার চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি বরং বেড়েছে দুর্নীতি আর এক জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে না হয় জনগণের সেবা পাওয়া সহজ, না হয় আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার যা দুর্নীতিকে সহজে তার প্রাচীরের মধ্যে ঢুকতে দিত না। জেলা পর্যায়ে ডিসি অফিস ছিল সচিবালয়ের মতোই কঠিন। দিনে দিনে তা জনমুখী করার প্রচেষ্টার ফলে এখন যা হয়েছে শুধু রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই নয়, এলাকার সব ধরনের প্রভাবশালীরাই এই ধরনের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বসে, তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। সমস্যাটা বেধেছে এখানেই। এখন না আছে আমলাতন্ত্র, না আছে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব। তাই, কে কোনটি করবেন বা কার কতটুকু করণীয় এ নিয়ে সব বিষয় ঘোলাটে হয়ে আছে। এলাকার স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ হবে, প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ নিয়োগ হবে। প্রয়োজন ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে প্রকৃত একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া, প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া। কিন্তু আমাদের সংসদ সদস্যরা উপযুক্ত কোনো শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ যাতে নিয়োগ না হয়, তাদের নির্ধারিত লোকদের যাতে নিয়োগ দেয়া হয় সেই প্রচেষ্টার সবটাই করে থাকেন। ফলে যা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, অভিভাবক, এলাকার নিরীহ লোকজন সবাই চান যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো কমিটিতে যাতে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকে বরং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা জেলা প্রশাসকরা থাকেন, তাতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা তাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়। কারণ ওই ধরনের পাবলিক রিপ্রেজেন্টেটিভদের থেকে মাঠ পর্যায়ের এসব আমলাকে সাধারণ মানুষ ঢের পছন্দ করেন, তাদের ওপর নির্ভর করা তারা অনেকটাই নিরাপদ মনে করেন। তারই অংশ হিসেবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘নিয়োগ পুল’ গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে। বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধ করার জন্যই এই প্রস্তাব। তবে সাধারণ শিক্ষকরা ২০১৫ সাল থেকে এই দাবি করে আসছেন, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে খসড়াও তৈরি করে রেখেছে কিন্তু এমপিদের চাপে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। জানা যায়, এবার সম্মেলেনে একজন জেলা প্রশাসক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সিন্ডিকেট এবং পরিচালনা কমিটিতে ডিসিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। জেলা পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার সার্বিক সমন্বয়ের জন্য এটা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময় আন্দোলন বা ধর্মঘটে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ডিসি সহায়তা দিতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন। জেলা প্রশাসকরা তাদের সম্মেলনে এমন কোনো কিছু বাদ রাখেননি যেগুলোর ওপর তাদের কর্তৃত্ব ফলানোর প্রস্তাব করেননি। একটি জেলার সব বিষয়ে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, জমিজমা থেকে মাদক, খেলাধুলা থেকে মারামারি, নদী ভাঙন থেকে রাস্তায় কীভাবে বাস চলবে ইত্যাদি সব কিছুতেই ডিসিরা তাদের সরাসরি অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন। আমার জানতে ইচ্ছে করে, তাহলে সংসদ সদস্যদের কী কাজ? শুধু পার্টির বন্দনা করা? একজন সংসদ সদস্য যদিও আইন প্রণেতা; কিন্তু তিনি তো তার এলাকার প্রকৃত জনপ্রতিনিধিও। তারা কি এসব কথা সংসদে তুলে ধরেন না বা ধরলেও তাতে কি কোনো কাজ হয় না? সংসদ সদস্যরা কি এগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না? সবই ডিসিদের করতে হবে? আমরা ব্রিটিশ হটালাম, পাকিস্তান হটালাম কিন্তু জনগণ ও দেশকে সেবা প্রদানে যে বাধা এবং বিপত্তি সেগুলো একটুও হটাতে তো পারিইনি বরং বাড়িয়েছি। জেলা কোটাসহ অন্যান্য কোটার সুবাদে এখন অনেকেই প্রশাসন ক্যাডারের বড় বড় কর্মকর্তা কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই যত বড় পজিশন তত সেবা কি জনসাধারণ তাদের কাছ থেকে পাচ্ছে? এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অনেকের ক্ষেত্রেই তিক্ত। তবে ব্যতিক্রম অনেকেই আছেন, আর আছেন বলেই এতকিছুর মধ্যে হলেও ব্রিটিশ প্রবর্তিত প্রশাসন ব্যবস্থা এখনো টিকে আছে। কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দেখেছি তারা শুধু মুখিয়ে থাকেন কখন কোন প্রোগ্রামে স্ত্রী-পুত্রসহ বেড়াতে যাবেন অন্যের ওপর নির্ভর করে কিংবা সরকারি অর্থের অপচয় করে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষকদের কাছে শুনেছি আমাদের অনেক কর্মকর্তা বিদেশে কোনো কোর্সে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেন, কারণ ছড়ি ঘোরাতে তারা যত মজা পান নিজেদের পড়াশোনার ব্যাপারে ততটা উৎসাহী নন। আর আন্তর্জাতিক কোনো ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতার যে অভাব সেটি তো আছেই। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন- ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থায় অনলাইনে বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।’ এসব কাজে শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও সংযুক্ত করা প্রয়োজন। একজন বিভাগীয় কমিশনার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যাওয়ার সুযোগ চেয়েছেন। বর্তমানে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীসহ পুলিশ ও আনসার সদস্যরা মিশনে পোস্টিং পেয়ে থাকেন। কিন্তু বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সেখানে গিয়ে কী করবেন? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশসমূহে শান্তিমিশনে বাংলাদেশসহ বেশকিছু দেশ থেকে জাতিসংঘ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর লোকদের পাঠিয়ে থাকে কারণ জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। আমাদের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কি মনে করেন যে, তারাই সব কাজের কাজী? কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রতি আমার এক ধরনের বিশ্বাস ছিল, অনেক উঁচু আসনে দেখতাম তাদের। তার কিছু কারণও ছিল। প্রশাসন ক্যাডারের বেশ কিছু অফিসারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা চলাফেরায় সে ধরনের একটি ধারণা জন্মেছিল যে, তাদের আই কিউ খুব শার্প, তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, কাজ সবই অন্যান্য যে কোনো ক্যাডার থেকে আলাদা। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যতিক্রম কিছু অফিসার ছাড়া অনেক উচ্চপদস্থ অফিসারদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ দেখে সব ধারণা পল্টে গেছে। অনেককেই দেখেছি ভালোভাবে বাংলাও বলছেন না। বেসরকারি কোনো প্রোগ্রামে গেলে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনসহ ভূরিভোজ, কেনাকাটা আর ঘুরে বেড়ানোই যেন অন্যান্য সব কাজের চেয়ে মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। আবার নিজেদের আলাদা বা অন্য গ্রহের লোক মনে করেন। আর রাজনৈতিকভাবে পদায়ন পাওয়ার কথা তো কারোরই অজানা নয়। এ ধরনের কর্মকর্তারা জাতির জন্য কী সেবা দেবেন সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। আর ইংরেজির যে ঘাটতি দেখলাম অনেক উচ্চপদস্থ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তাতেও ধারণা পাল্টে গেছে। আমাদের সেনা অফিসাররা অবশ্য বিদেশি মিশনে ভালোভাবেই পেশাগত দক্ষতা ও যোগাযোগ দক্ষতা প্রদর্শন করে আসছেন, যার কারণে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আমি নিজে পশ্চিম আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিয়েরা লিয়নে তার প্রমাণ দেখে এসেছি, সেখানে বাংলা ভাষারও প্রচলন আছে। বাংলাদেশিদের তারা আলাদা সম্মান প্রদর্শন করে। আমাদের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যদি দেশের বাইরে সে ধরনের কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন সেটি তো অবশ্যই প্রশংসীয় হবে। সেটির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসার উদাহরণ সৃষ্টি করা শুধু বক্তব্য দেয়া নয়।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App