×

মুক্তচিন্তা

নোবেল পুরস্কার : এবার ভিন্ন মূল্যায়ন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৩৭ এএম

জার্মান সাংবাদিক কার্লভন ওসিয়েৎজকির পর এই প্রথম কোনো সাংবাদিক নিজের সরকারের দুর্নীতির গোপন তথ্য প্রকাশ্যে এনে নোবেল পেলেন। সেই ১৯৩৫ সাল আর আজকের ২০২১ সাল। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সাংবাদিকের এমন চমকধরা নোবেল প্রাপ্তি যেন সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অর্জন। গোপন তথ্য প্রকাশ্যে এনে নোবেলভাগ্য শিঁকে চড়ল মুরাতভের। রাশিয়ার তদন্তমূলক সংবাদপত্র ‘নোভায়া গেজেটা’-এর এডিটর ইন চিফ হিসেবে ভ¬াদিমির পুতিন সরকারের বহু দুর্নীতিকে দিনের আলোয় এনেছেন মুরাতভ। বিশেষ করে ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে তার তদন্তমূলক প্রতিবেদন যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছিল ক্রেমলিনকে। কিন্তু মজাটা দেখুন, সেই খোদ ক্রেমলিন থেকেই নোবেল পুরস্কার লাভের জন্য সরকারিভাবে মুরাতভকে অভিনন্দন জানানো হলো। সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভের পর রাশিয়ান হিসেবে মুরাতভই দ্বিতীয় কেউ নোবেল পেলেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৯০ সালে পাওয়া নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়েই ‘নোভায়া গেজেটা’ সংবাদপত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন গর্বাচভ। আজ ৩১ বছর পর সেই নোভায়া গেজেটার মুরাতভই লাভ করলেন শান্তিতে দ্বিতীয় নোবেল। ২০১২ সালে ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা ‘র‌্যাপলার’ প্রতিষ্ঠা করেন ফিলিপাইনের মারিয়া রেসা। তদন্তমূলক সাংবাদিকতার মাধ্যমে পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানের আড়ালে গণহত্যাসহ রডরিগো দুতার্তে সরকারের একাধিক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পর্দা ফাঁস করে প্রচারের আলোয় আসেন মারিয়া। স্বাভাবিক কারণেই তিনি সরকারের বিষনজরে পড়ে যান। তার বিরুদ্ধে রুজু হয়ে যায় একাধিক মামলা। যদিও এমনই এক মামলায় আগস্ট ২০২১ ফিলিপাইনের আদালত মারিয়াকে নির্দোষ হিসেবে সাব্যস্ত করেছিল। তারপরও রডরিগো দুতার্তের কঠোর সমালোচক হিসেবে তিনি বরাবরই প্রেসিডেন্ট ও সরকারের সমর্থকদের নিশানায় পড়েছেন। রেসা জানান, সবটাই ছিল তাকে এবং তার সংস্থার গুরুত্বকে শেষ করার চেষ্টা। সরকার এ কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়াকে। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পরদিনই ফেসবুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক ফেসবুক। তার অভিযোগ- বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ সমাজমাধ্যমটি ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো রুখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তথ্য নিয়ে একেবারেই নিরপেক্ষ নয় সংস্থাটি। তিনি আরো বলেন, ফেসবুকের অ্যালগরিদমে সব সময়ই প্রাধান্য পায় মিথ্যা খবর এবং ক্ষোভ ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ সংবাদ। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়িয়ে কীভাবে আমরা পৃথিবীর উষ্ণায়ন ঘটিয়ে চলেছি, বদলে ফেলছি আমাদের একমাত্র বাসস্থানের জলবায়ু- বৈজ্ঞানিকভাবে তা পরিমাপ ও অনুমানের রাস্তা দেখিয়েছেন জাপানি বংশোদ্ভূত আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্যুকুরো মানাবে এবং জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর মেটিরিয়োলজির বিজ্ঞানী ক্লাউস হাসেলমান। এ দুজনকেই এবার দেয়া হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার। এদের সঙ্গে নোবেল পেয়েছে তৃতীয় পদার্থবিজ্ঞানী জর্জিয়ো পারিসিও। পারিসি রোমের সাপিয়েনজা ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী। শরীরতত্ত্বে এবার দুই নোবেল বিজয়ী। অধ্যাপক ডেভিড জুলিয়াস এবং অধ্যাপক আর্ডেম পাটাপুটিয়ান। আমাদের স্পর্শন্দ্রিয় কীভাবে সাড়া দেয় পরিবেশকে? কীভাবে বোঝে উষ্ণতা ও শৈত্য? কীভাবে অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর স্পর্শবোধ করি আমরা? আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যা খুব জরুরি, সেই স্পর্শবোধ অনুভূতির জটিল রহস্য ভেদ করার জন্যই দেয়া হলো এ বছরের শরীরতত্ত্ব-চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার। আমাদের গাত্রত্বকের ঠিক নিচে থাকা স্নায়ুগুলো কীভাবে চট করে ধরে ফেলতে পারে তাপমাত্রার তারতম্য? উষ্ণতা-শৈত্য, বিভিন্ন ব্যক্তি বা বস্তুকে আমাদের ¯পর্শ করার অনুভূতি কেন ও কীভাবে একে অন্যের চেয়ে আলাদা হয়, তার কারণ জানতে কাঁচা লঙ্কা থেকে পাওয়া একটি যৌগকে ব্যবহার করেছেন জুলিয়াস। একটু কটুু গন্ধের সেই যৌগটির নাম ‘ক্যাপসাইসিন’। এ যৌগটি ¯পর্শ করলে আমরা ত্বকে তীব্র জ্বালাবোধ করি। এ যৌগটির মাধ্যমেই জুলিয়াস প্রথম জানতে পারেন, আমাদের স্নায়ুর সেন্সরগুলো কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও পরিবেশকে সাড়া দেয়; একইভাবে তিনি তাপমাত্রার তারতম্যও বুঝতে পারেন। অন্যদিকে অধ্যাপক পাটাপুটিয়ান প্রথম দেখেছিলেন, কীভাবে আমাদের ত্বক ও বিভিন্ন অঙ্গে থাকা স্নায়ুগুলো বাইরের নানা ধরনের চাপ বুঝতে পারে এবং তাদের হ্রাস-বৃদ্ধি অনুভব করতে পারে। চাপ ও তার তারতম্য বুঝতে পারে এমন কয়েকটি মানবকোষকে ব্যবহার করে পাটাপুটিয়ান আমাদের স্নায়ুর এমন কয়েকটি সেন্সরের সন্ধান পেয়েছিলেন, যা বাইরের যে কোনো চাপ আর গন্ধ সঙ্গে সঙ্গে কানে পৌঁছে দেয়। এ দুটি আবিষ্কার অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু ও পরিবেশের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়ার জটিল রহস্য ভেদ করেছে। পরিবেশকে কীভাবে স্নায়ুতন্ত্র বোঝে ও চেনে, সে পথগুলোই তিনি আবিষ্কার করেছেন। পরিবেশকে আমরা কীভাবে চিনতে পারি, বুঝতে পারি- মানুষের এ প্রশ্ন ছিল হাজার বছরের। আলো এলেই আমরা বুঝতে পারি- এটা অন্ধকার নয়, আলো। কীভাবে আমরা তা বুঝি? কীভাবে বুঝি, এটা লাল কিংবা নীল রঙের আলো, নাকি হলুদ বা সবুজ? কীভাবে আমাদের কান বুঝে নিতে পারে কোনটা কর্কশ শব্দ, কোনটা মিঠে সুরের শব্দ? কীভাবে আমরা বুঝতে পারি কোন সুরে তাল-লয় আছে, আবার কোথাও গিয়ে সেই তাল-লয় ভেঙে যাচ্ছে? জিভ কীভাবে বুঝতে পারে কোনটা তেতো, কোনটা ঝাল বা কোনটা অমø? খুব গরমে দুপুরে খালি পায়ে ঘাসে হাঁটলে আমরা সূর্যের তাপ অনুভব করতে পারি, প্রত্যেকটি ঘাসকে আলাদাভাবে অনুভব করা যায়। ঘাসগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসও টের পায় আমাদের খালি পায়ের নিচে থাকা স্নায়ুগুলো। মস্তিষ্কের সঙ্গে যে আমাদের ত্বকের বিভিন্ন অংশের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে এবং এদের মধ্যে নিয়মিত বার্তা বিনিময় হয়, তা সপ্তদশ শতাব্দীতেই প্রথম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত। তাই গরম উনুনে পা দিলে আমাদের অনুভূতি যে রকম হয়, বরফে পা দিলে ঠিক সে রকম অনুভূতি হয় না। পরিবেশের এ তারতম্য ধরার ক্ষেত্রে যে আমাদের মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা স্নায়ুকোষ আছে, সে কথা প্রথম জানানোর জন্যই ১৯৪৪ সালে শরীরতত্ত্ব-চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দুই বিজ্ঞানী- জোসেফ এরলাঙ্গার ও হারবার্ট গ্যাসার। তারা দেখিয়েছিলেন, কোনো বিশেষ স্নায়ুকোষ আমাদের যন্ত্রণা বুঝতে সাহায্য করে; আবার কোনো স্নায়ুকোষ আদর বুঝে উঠতেও সক্ষম হয়। কিন্তু তখনো তাপমাত্রা আর বাইরের চাপের ভিন্নতা কীভাবে মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা বিদ্যুৎ তরঙ্গ পাঠায়, তা বুঝে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না। এবার সে পথই দেখালেন জুলিয়াস এবং পাটাপুটিয়ান। সানফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড জুলিয়াস তার সঙ্গীদের নিয়ে গবেষণাটি চালিয়েছিলেন গত শতাব্দীর নয় দশকের শেষ দিকে। কাঁচা লঙ্কা গায়ে ঘষলে কেন জ্বালা করে, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জুলিয়াস খোঁজ পেলেন লঙ্কায় থাকা একটি যৌগ ‘ক্যাপসাইসিন’-এর। কেন হয় জানতে মানবদেহের কোটি কোটি ডিএনএ টুকরোর লাইব্রেরি তৈরি করে ফেললেন জুলিয়াস ও তার দল। এসব ডিএনএ আমাদের শরীরের এমন সব জিনে রয়েছে, যেগুলো তাপ, যন্ত্রণা ও বিভিন্ন ধরনের ¯পর্শে জেগে ওঠে; আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে; আরো তৎপর হয়ে ওঠে। এভাবে বহু জিনের মধ্যে তারা শুধু একটি জিন খুঁজে বের করলেন, যা কাঁচা লঙ্কায় থাকা যৌগ ক্যাপসাইসিনের ¯পর্শ পেলেই জেগে ওঠে, সক্রিয় হয়ে ওঠে। তন্নতন্ন করে তারা খুঁজে বের করলেন মানব শরীরে ক্যাপসাইসিনের গন্ধ শুঁকতে সক্ষম জিনটিকে। পরে তারা এ-ও দেখালেন, একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন তৈরি করতেও এ জিনটি মূল ভূমিকা নিচ্ছে। ওই প্রোটিনই আমাদের স্নায়ুকে তাপমাত্রা, যন্ত্রণা ও বিভিন্ন ধরনের ¯পর্শের তারতম্য বুঝিয়ে-চিনিয়ে দেয়ার একমাত্র গাইড। এর তারতম্যই মস্তিষ্কে বিভিন্ন ধরনের বিদ্যুৎ তরঙ্গের জন্ম দিচ্ছে। আর তার ফলেই আমাদের বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। আমাদের স্নায়ুগুলো তাপের তারতম্য কীভাবে বুঝতে পারে, তা না হয় বুঝা গেল। কিন্তু বাইরের চাপের তারতম্যের গন্ধ কীভাবে শুঁকতে পারে আমাদের স্নায়ু, সেটা দেখালেন ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলায় স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আর্ডেম পাটাপুটিয়ান। পাটাপুটিয়ান এবং তার দল গবেষণা করে সন্ধান পেলেন, মানবদেহে ৭২টি এমন জিন রয়েছে, যা বাইরের চাপ আর তার তারতম্যে জেগে ওঠে বা আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে আবার দুটি জিন এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে- পিয়েজো-১ এবং পিয়েজো-২।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App