×

অর্থনীতি

‘কাগুজে’ বিদেশি বিনিয়োগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৩২ এএম

‘কাগুজে’ বিদেশি বিনিয়োগ

ফাইল ছবি

সাড়া মেলে নিবন্ধনের এক-তৃতীয়াংশের,হ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সুশাসনের অভাব

দেশে কাগজে কলমে যে পরিমাণ বিনিয়োগ আসে, বছর শেষে সে হার বাস্তবতার সঙ্গে মিলে না। প্রতি তিন মাসে যতসংখ্যক বিনিয়োগ প্রস্তাব বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিডা) নিবন্ধিত হয়, বছর শেষে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। উন্নয়নকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী একটি শ্রমশক্তিও তৈরির পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং। সংস্থাটির মতে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান বাড়ানোর সঙ্গে বিনিয়োগও জড়িত। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে।

দেখা গেছে, করোনা মহামারির সময়ে বিনিয়োগ কমেছে। অবশ্য এ সময়ে বিশ্বেরও গড় বিনিয়োগ কমেছে। করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ পেতে সক্ষম হয়নি বাংলাদেশ। তবে ২০২১ সালে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ছিল নানা তোড়জোড়। বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে অনেক সভা, সেমিনার ও রোড শো হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে হাইটেক পার্ক ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোনের মতো সংস্থাগুলোর উদ্যোগ বছরজুড়ে ছিল দৃশ্যমান। ব্যবসা সহজ করতে বিভিন্ন সংস্থার অটোমেশন ও ডাটা ইন্ট্রিগ্রেশন প্রক্রিয়া, রোড শো, দুবাই এক্সপোতে অংশ নেয়া, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসায়িক সমঝোতা, আন্তর্জাতিক ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজনসহ দেশে বিনিয়োগে করছাড় ও নানা সুযোগ-সুবিধা দেয় সরকার। এরপরও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাপান টোব্যাকোর ১৫০ কোটি ডলারের একটি বড় বিনিয়োগ এসেছিল বাংলাদেশে। এরপর আর কোনো বড় বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। এমনকি চীন ও আমেরিকার

বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন থেকে ৮৬টি জাপানি কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে জাপানি ওইসব কোম্পানি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারে গেলেও বাংলাদেশে আসেনি। তবে গত নভেম্বরে বিডা আয়োজিত আন্তর্জাতিক সামিটে সৌদি আরবের কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশনস বাংলাদেশে ১৫০ কোটি ডলার (১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করতে চুক্তিনামায় সই করে। বিডা জানিয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনসনস বাংলাদেশের দীপন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামে যৌথভাবে চিনি, সার ও বেভারেজ শিল্পে বিনিয়োগ করবে। এছাড়া দেশের তিতাস এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে যৌথভাবে সিমেন্ট কারখানা গড়ে তুলবে সৌদি কোম্পানিটি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন প্রকল্প নিবন্ধনের যেসব প্রস্তাব আসে, শেষ পর্যন্ত সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন না-ও হতে পারে। তাই নিবন্ধন বাড়লেও সেটা বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র নয়। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে বের করে দ্রুত এর সমাধানের কথা বলেন তারা। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, নতুন প্রকল্প নিবন্ধন ও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের বর্তমান চিত্র সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও নতুন প্রকল্প নিবন্ধনের যেসব প্রস্তাব আসে, শেষ পর্যন্ত সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হতে না-ও পারে। তাই প্রকল্প নিবন্ধন বাড়লেও সেটা বিনিয়োগ বাড়াতে খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র নয়।

তিনি বলেন, এক কথায় বললে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়নি। বিনিয়োগ না হওয়ার মূল কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সুশাসনের অভাব। আর এ দুই সমস্যার কোনো উন্নয়ন হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশের নিয়মিত সমস্যা হলো অবকাঠামোগত দুর্বলতা। বিশেষ করে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ। আর গ্যাস না হলে বিনিয়োগ করা যায় না। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রæতিতেই সীমাবদ্ধ। প্রতি বছর দেশে যে হারে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়, বাস্তবায়ন হার তার ধারেকাছেও নেই। আবার যেটুকু বাস্তবায়ন হয়, তার পুরোটাই বিদেশি পুনর্বিনিয়োগ। কাগজে কলমে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়লেও তার সুফল পাচ্ছে না দেশ। এছাড়া নতুন বিনিয়োগ বাস্তবায়নের হার একেবারেই সামান্য। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি, সরকারি এবং বিদেশি বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

তথ্য অনুযায়ী, করোনা অতিমারির মধ্যে গত দুই বছরে বাংলাদেশ ২১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন বা দুই হাজার ১১৭ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিডা জানায়, সংস্থাটি দুই বছরে ১ হাজার ৪৭৭ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ৫০০ কোটি ডলার এবং বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ১৩৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ২৫০ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ২৩৭ কোটি ডলার।

বিডা আরো জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস অতিমারি শুরু হলেও আগের বছর মোট ৭১২ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছিল এ সংস্থা। এর মধ্যে ৪৮৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের থেকে। এর বাইরে শুধু বিদেশি এবং বাংলাদেশিদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল আরো ২২৬ কোটি ডলারের। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিডা ৭৬৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগ ৬৮৫ কোটি ডলারের এবং বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে ৮০ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে একটা চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে পুরো বিশ্ব। সব দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রস্তাব আসা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। আশা করছি, নতুন অর্থবছরে বিনিয়োগগুলো আসতে শুরু করলে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি এর সুফল পাবে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে নিবন্ধিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৮৯টি। নিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সাতটি বিদেশি বিনিয়োগ ও পাঁচটি যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে সাতটি বিদেশি ও পাঁচটি যৌথ বিনিয়োগসহ মোট ১২টি বিনিয়োগ প্রস্তাব হয়েছে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে। আর স্থানীয় বিনিয়োগ ১ লাখ ৮৫ হাজার মিলিয়ন টাকা। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৮ হাজার ৮৭৩ মিলিয়ন টাকা বেশি।

বিডার সব ধরনের বিনিয়োগ টানতে বছরজুড়েই ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন উদ্যোগ। বছরের শুরুতেই বিডা তাদের ওয়েবসাইটে ৪১টি সেবা যোগ করে। যেখানে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সহজীকরণে বহুমুখী সেবা একীভূত করা রয়েছে। অর্থাৎ বিডার নিবন্ধন নিয়ে এখন থেকেই বিনিয়োগের জন্য জমি বা ভূমি রেজিস্ট্রেশন, সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের নামজারি সনদ সেবা দেয়া শুরু করে। এ ছাড়াও বছরের বাকি সময় ওএসএসের আওতায় আরো ২০ সেবা সংযুক্ত করা হয়। এর ফলে বিনিয়াগকারীরা এখন আবেদনের ১৮ দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে পারেন। এছাড়া ব্যবসার জন্য ছাড়পত্র সনদ পেতে সময় লাগে মাত্র এক সপ্তাহ এবং আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স করপোরেশনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় নতুন বছরে ৩৫টি সংস্থার সর্বমোট ১৫৪টি পরিষেবা বিডা দেবে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App