×

জাতীয়

উন্নয়ন, সন্ত্রাস বিরোধিতা ও স্বচ্ছতায় বাজিমাত আইভীর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:১২ এএম

উন্নয়ন, সন্ত্রাস বিরোধিতা ও স্বচ্ছতায় বাজিমাত আইভীর

নারায়ণগঞ্জের পুনর্নির্বাচিত মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী

ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী হ্যাটট্রিক জয়ের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে অনেকগুলো কারণ। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী অবস্থান, ব্যক্তি ইমেজ এবং তৃণমূল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সমর্থনে বড় ব্যবধানে জয় সুনিশ্চিত করেছে। ‘গডফাদার’ শব্দ উচ্চারণ করে তিনি নির্ভিকতার প্রমাণ দিয়ে ভোটারদের আস্থা কুড়িয়েছেন। ‘ভাতিজি’ আইভীকে বরণ করে নিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূরও। নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলাপ করে নৌকার বিপুল বিজয়ের এমন কারণ জানা গেছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হওয়ায় সেখানকার মানুষ উন্নয়নকে বেছে নিয়েছে। সন্ত্রাস ও মাদক মুক্ত নগরী গড়তে পরিচ্ছন্ন ইমেজ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি মানুষের কাছে আইভীকে গ্রহণযোগ্য করে তুলে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভয়ে সবাই যখন তটস্থ সেখানে আইভীর প্রতিবাদী ভূমিকা সবমহলে প্রশংসিত। অন্য যারা প্রার্থী হয়েছিলেন- সাধারণ ভোটাররা তাদের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে ফের আইভীকেই বেছে নিয়েছে। তার মতে, আইভী মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে পাশে থাকেন।

নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েলের মতে, তিন কারণে আইভী জিতেছেন। এর মধ্যে ১. স্বচ্ছতার সঙ্গে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, ২. সততা ও ৩. সুন্দর নগরী গড়তে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তার সাহসী ভূমিকা। জুয়েল বলেন, স্থানীয় বিএনপির বিরোধ ও বিএনপি থেকে তৈমূর আলম খন্দকারকে দলীয়ভাবে সমর্থন না দেয়ায় তাদের ভোট পড়েছে আইভীর বাক্সে। আবার ইসলামিক ফ্রন্টসহ বেশ কয়েকটি ইসলামি সংগঠন ছিল তার পাশে।

জেলা জাসদ সভাপতি মোহর আলী বলেন, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, কাজের গুণগত মান এবং সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান আইভীকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে আরও উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নারায়ণগঞ্জ শাখার একাধিক নেতা মনে করছেন, বিএনপির সাবেক সাংসদ আবুল কালাম ও গিয়াস উদ্দিন ছাড়াও প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন ও জাকির খান ছিলেন নীরব। তবে তাদের অনেক অনুসারী আইভীর জন্য কাজ করেছেন প্রকাশ্যে। সেখানকার ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্ব স্থানীয় কয়েকজন ওপেন-সিক্রেট তৈমূরের হাতির জন্য কাজ করলেও সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা ছিলেন নৌকার পক্ষে। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে আগলে রেখেছেন মাঠের নেতাকর্মীদের। শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠরা অনেকে লোক দেখানো প্রচারণা চালালেও সাধারণ মানুষের কাছে তা ছিল অভিনয় সমতুল্য। আইভী এসব বিষয় মাথায় রেখেই ‘নিজের বল বাহুবল’- এমন ভাবনা নিয়ে কাজ করেন।

এদিকে আইভীর একাধিক ঘনিষ্ঠজন নিশ্চিত করে বলেছেন, শামীম ওসমানের ওপর মিডিয়ার চোখ থাকলেও আইভী বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। ওসমান পরিবারকে ‘নেগেটিভ’ ধরেই জয়ের ছক আঁকেন তিনি। ওসমান পরিবারের ভোট ব্যাংক হিসাবে নিয়ে সেগুলো বাদ দিয়ে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ের ছক আঁকেন গত দুবারের এই মেয়র। প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে ‘চাচা তৈমূরকে’ হারালেও ব্যবধান কম হওয়ার আক্ষেপ তার রয়েই গেছে। এজন্য ভোটার উপস্থিতি কম এবং ইভিএম মেশিনে স্লো ভোটগ্রহণকে দায়ী করেন আইভী। তিনি মনে করেন, দলীয় পরিচিতির বাইরে তার ব্যক্তিগত ইমেজ সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ভোটারদের একটি বড় অংশও তার সঙ্গে থাকে। বিশেষ করে নারী ভোটাররা দলমত নির্বিশেষে তাকে বেছে নেয়। তরুণদের বড় একটি অংশ তাকে পছন্দ করেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রথমবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আইভী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পরেরবার বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দুবারই তার প্রতিপক্ষ ছিল চিহ্নিত। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বিএনপি নেতা তৈমূর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দাবি করেন তিনি জনগণের মনোনীত প্রার্থী। তার সঙ্গে মাঠে নামেন বিএনপির অনেকে, সঙ্গী হন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ (বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের নেতা) এস এম আকরাম ও হেফাজতে ইসলাম। পেছনে ছিল জামায়াত। গুঞ্জন আছে, ওসমান পরিবারের হাত ছিল তৈমূরের মাথায়। অবশ্য তৈমূর তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রচার প্রচারণার ধরনে তৈমূর চমক দেখাতে পারেন এমন ইঙ্গিত তৈরি হয়। তবে, জয়ের ব্যাপারে শুরু থেকে শতভাগ আশাবাদী আইভী আস্থা রাখেন জনগণের ওপর। ১৬ জানুয়ারির ভোটে শেষ হাসি হাসেন তিনিই।

নাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তারের দেয়া তথ্য মতে, আইভী নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ ভোট পেয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৭১ ভোট। অর্থাৎ ৬৯ হাজার ১০২ ভোট বেশি পেয়ে তৈমূর আলম খন্দকারকে পরাজিত করেন আইভী।

২০১১ সালের ৫ মে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এক লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট পেয়ে শামীম ওসমানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ান এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভী ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোটে আবার নির্বাচিত হন। সেবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন পান ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। এবার অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বড় ব্যবধানে তৃতীয়বারের মতো মেয়র হলেন আইভী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App