×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচন : গণতন্ত্রের পশ্চাদ্ধাবন!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০৬ এএম

দফায় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশে। সারা বছর ধরেই চলে নানা স্তরের নির্বাচন- বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এর মধ্যে ইতিহাসের পরিষদ নির্বাচনগুলোকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। বুঝে নিতে পারি নির্বাচনগুলো কেমন হলো, গণতন্ত্রই বা কেমন এগুলো? অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নির্বাচন হয়ে গেল। এই নির্বাচন আগে ছিল পুরোপুরি নির্দলীয়। কোনো প্রকার দলীয় মনোনয়ন নিতে হতো না। যারা নির্বাচনে দাঁড়াতেন তারা কে কোন দল করেন বা না করেন ভোটাররা নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে আনতেন। যারা চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হতেন তাদের মধ্যে খুব বেশি হলে ২০-২৫ ভাগ বা তার কম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হতেন। সারাজীবন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে এমন চেয়ারম্যানও ছিল বেশ ভালো সংখ্যায়। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব না হলে আজীবন প্রতিটি নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া যে সম্ভব না, তা বুঝতে আদৌ কোনো কষ্ট হয় না। চেয়ারম্যান পদকে অত্যন্ত সম্মত পদ হিসেবে বিবেচনা করে যারা সৎ ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব তারাই দাঁড়াতেন। এদের মধ্যে একজন নির্বাচিত হতেন। তখন ইউনিয়ন অধিদপ্তরগুলোর সম্মানী ভাতা ছিল অনুল্লেখযোগ্য। তবে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সেক্রেটারি ছিলেন সরকারি বেতনভুক্ত এবং বদলিযোগ্য। এদের বেতন চেয়ারম্যান-মেম্বারদের প্রাপ্ত ভাতার কয়েকগুণ বেশি ছিল তা সত্ত্বেও সেক্রেটারিদের দেখেছি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের যথেষ্ট সম্মান করতে, সমীহ করতে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কাজের বিষয়গুলো ছিল লক্ষণীয়। উন্নয়ন কাজ তারা খুব বেশি একটা করতে পারতেন না। কারণটি হলো তহবিলের স্বল্পতা। ইউনিয়ন ট্যাক্স আদায় হতো অনেক কম, গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের সংখ্যাধিক্যের কারণে। তাই মাঝে মধ্যে তাগিদ দিলেও ইউনিয়ন ট্যাক্স আদায়ের জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তেমন পীড়াপীড়ি করতেন না। হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় এসব নির্বাচনেরও জাতীয় সংসদের মতো দলীয় মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করায় গোটা দৃশ্যপট ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকল। তৃণমূল পর্যায়ে দলের ভেতরে মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ ও দলাদলি, দলে দলে সংঘাত, সন্ত্রাস প্রভৃতির শুরু হতে থাকে। প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ভালো কি মন্দ, সৎ কি অসৎ, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে কি নেই- সেই বিবেচনা প্রথা হিসেবেই উধাও ছিল। নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন নামক সোনার হরিণটি না পাওয়ায় মারামারি, ব্যক্তিগত অপপ্রচার, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে এক বা একাধিক ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সহকর্মীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া, প্রার্থীদের পক্ষ থেকে নেতৃত্বের সমর্থন আদায়ের প্রতিযোগিতার যে কোনো মূল্যে অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে হোক বা সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে হোক বা ভয় দেখিয়ে হোক বা পোলিং এজেন্ট হিসেবে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর মনোনীত কাউকে ঢুকতে না দিয়ে বা কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে ভোট দেয়ার মতো অবৈধ পদ্ধতি হিসেবে জিতে আসার প্রবণতা এখন যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন বা রিটার্নিং অফিসারদের প্রভাবিত করে সরকারদলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ছাড়া বাদ-বাকি কারো মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করে জমা দান, সেগুলো যাচাই-বাছাই, বৈধ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ এসব প্রক্রিয়ার বুকে লাথি মেরে বিজয়ী বলে ঘোষণা, প্রচার মিছিলের বদলে বিজয় মিছিল বের করাও কোথাও কোথাও শুরু হয়ে গেল। একটি উদ্বেগজনক খবর বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১-এ জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম ছিল- ‘মনোনয়ন জমা হওয়ার আগেই ১১ ইউপি প্রার্থীর বিজয়’। এতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ষষ্ঠ ধাপে মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় আগামী ৩ জানুয়ারি। কিন্তু কুমিল্লায় মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১ ইউনিয়নের ১১ চেয়ারম্যান প্রার্থী ইতোমধ্যে কথিত বিজয় নিশ্চিত করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী ১৩ জানুয়ারি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে ওই ১১ জনকে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী বলেও স্থানীয়ভাবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে এই ১১ জনের বাইরে অন্য কারো কাছে মনোনয়নপত্র বিক্রি করছেন না রিটার্নিং কর্মকর্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ১১ জনকে নৌকার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে পোস্টারও ছাড়া হয়েছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিনন্দনও জানানো হয়েছে।

ধরণী দ্বিধা হও আজ দুই-তিন মাস ধরে সারাদেশের শত শত ইউনিয়নের নির্বাচন, বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়া, ভয়াবহ সহিংসতা, খুন-লুটপাট, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার উসকানি প্রদান, হুমকি-ধমকি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অনাকাক্সিক্ষত এবং আইনবহির্ভূত এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রবিরোধী আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের যে অভিযাত্রা তাতে এ কথা বলাই যায়, গণতন্ত্র নির্বাচনের নামে নির্বাসনে যেতে বসেছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ কথাটি নতুন করে প্রতিফলিত হতে চলেছে। এ ঘটনাগুলো সাবেক যুবরাজ রাজত্ব বাঞ্ছাদের রাজত্ব দখলের কাহিনীগুলোকেই ভিন্ন মোড়কে সত্য প্রমাণিত করছে মাত্র। বস্তুত এসব নির্বাচনের সঙ্গে জনগণের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে এগুলো কার্যত নির্বাচনের নামে প্রহসন মাত্র। কিন্তু যেনতেন প্রকারে নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা কেন? অতীতে তো তেমনটা দেখিনি। তবে কি ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পদ অত্যন্ত লোভনীয়? সেখানে মধুর সন্ধান মিলেছে ভাবছে দেখে তো তেমনটাই মনে হয়। বহু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, নানা অবৈধ ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছেন, কেউ কেউ চোখ ধাঁধানো বাড়ির মালিকও হয়েছেন। কিন্তু এই মধুর চাক কি চিরস্থায়ী। না-ইতিহাস তা বলে না। একদিন না একদিন জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ ওই চাকগুলোতে ঢিল ছুড়তে যাবে, মৌমাছিদের তখন হয় মৃত্যু নয়তো অজানা উদ্দেশে অসহায়ভাবে পালিয়ে বাঁচতে হবে। এর পরিণতিতে মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়ছে। তারা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা নিরর্থক ভেবে চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করছেন। অঘোষিতভাবে ভালো মানুষরা, গণতন্ত্রপ্রেমীরা, সৎলোকের নির্বাচনী রাস্তায় হাঁটাই বন্ধ করে দিয়েছেন। আরো একটি বিজয় লক্ষণীয়। যেসব ইউনিয়ন পরিষদে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, মানুষ ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারছে- সরকারি দল এমন বহু এলাকায় নির্মমভাবে পরাজিত হচ্ছে। তাদের দলীয় জনপ্রিয়তাও নিম্নতর পর্যায়ে নেমে আসছে। এগুলো শুধু ইউপি নির্বাচনগুলোর মধ্যেই সীমিত রয়েছে, তা নয়। বহু পৌরসভায়ও তেমনই পরিস্থিতি। আর সংসদীয় নির্বাচন? তা নিয়ে যত মতানৈক্য তার কি সবই ভিত্তিহীন। যথার্থভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয় এমন ঘটনায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। দিনে দিনে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাই বেদনাদায়ক সত্যটি হলো, কথিত নির্বাচনগুলো প্রকৃত নির্বাচন নয়, এগুলোতে মানুষ সংশ্লিষ্ট নয়। তাই গণতন্ত্র এগুলোর মাধ্যমে নির্বাসনে যেতে বসেছে।

  রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App