×

অর্থনীতি

বিশাল লক্ষ্যমাত্রার বাজেট প্রস্তুতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৫ এএম

বিশাল লক্ষ্যমাত্রার বাজেট প্রস্তুতি

প্রতীকী ছবি

সম্ভাব্য আকার ৬,৭৫,১৩৯ কোটি টাকা, আয় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা

করোনা ভাইরাস মহামারির নতুন ধরন ওমিক্রনের আতঙ্কের মধ্যেই ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে সরকার। আসছে বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যদিও বাজেট প্রণয়নের মূল কাজ শুরু হবে মার্চে। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৫ দশমিক ৫, আর চলতি অর্থবছরের বাজেটের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।

চলতি বছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আসছে বছরের বাজেটে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধির টার্গেট ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান (২০২১-২২) বাজেটে এর টার্গেট ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সামনের বছর বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশে সীমিত রেখে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছে সরকার, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের বিষয় মাথায় রেখে এবারের বাজেট সাজানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের ব্যয়ের আকার পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়সীমা নিরূপণ করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে থাকবে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়। তবে উন্নয়ন খাতের প্রস্তাব অবশ্য সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল বা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা এবং সম্ভাব্য ব্যয়সীমাও পাঠাতে বলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে এসব তথ্যসহ প্রস্তাব জমা দিতে হবে অর্থ বিভাগে। এসব নির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে প্রাপ্ত ব্যয়সীমা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে বাজেট বৈঠক আয়োজন করা হবে। সেখানে ব্যয়সীমা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটি। এরপর খসড়া চূড়ান্ত করা হবে নতুন বাজেট কাঠামোর।

তথ্যমতে, করোনা মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের পথে থাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। আর মানবসম্পদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে না পারলে এসব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। ফলে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরকে তাগিদ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। তবে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে এনবিআর কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট গতানুগতিকতার দিকেই যাচ্ছে মন্তব্য করে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, গত বছরের মতোই এবারের প্রেক্ষাপট খুবই চ্যালেঞ্জের। মানুষের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিতেও বিরাজ করছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। ফলে আসছে বছরের বাজেটটাও কঠিন এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে উপস্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। কর কাঠামো নিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বছরের পর বছর ধরে কর কাঠামো সংস্কারের কথা বলা হলেও এ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। এর ফলে টাকার অঙ্কে অর্থনীতির আকার যে হারে বাড়ছে, বাজেটের পরিমাণও একই হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো অগ্রাধিকার খাতে প্রকৃত বরাদ্দ বাড়ানো যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে। এতে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান ও উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন সহজ হবে। এজন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ৩২ দশমিক ২ শতাংশ বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ২৫ দশমিক ৩ ও সরকারি খাতে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বিনিয়োগ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকার প্রাক্কলিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পরিচালন ও অন্যান্য খাতের ব্যয় হচ্ছে ৪ লাখ ২৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে এসব অঙ্কের কোনোটাই এখনো চূড়ান্ত নয়। এসব প্রাথমিক অঙ্ক। চলতি অর্থবছর ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

নিয়ম অনুযায়ী বছরের মধ্যভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী বাজেটের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া এরই মধ্যে অর্থ বিভাগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য একটি সম্ভাব্য ব্যয়সীমা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ব্যয় আকার হচ্ছে ৪ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। এ অর্থের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা এবং নারী উন্নয়নে ৭৪৯ কোটি টাকা ব্যয় হবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া হবে ৭৩১ কোটি টাকা। তবে এ অর্থের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসূচি থাকবে ৬৮১ কোটি টাকার এবং নারী উন্নয়নে থাকবে ২৭৬ কোটি টাকা। একইভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সম্ভাব্য ব্যয় সিলিং হচ্ছে ১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় হবে ৬৯৮ কোটি টাকা এবং নারী উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে ১৩৩ কোটি টাকা।

এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় সিলিং হচ্ছে ৪০ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, আইন ও বিচার বিভাগে সম্ভাব্য ব্যয় সিলিং ১ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগে ২৪ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যয়সীমা হলো ২৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিভাগে সম্ভাব্য ব্যয়সীমা ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ১৩৫ কোটি, স্বাস্থ্য বিভাগে ২৮ হাজার ৫০৫ কোটি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ৮ হাজার ৯৭০ কোটি, স্থানীয় সরকার বিভাগে ৪১ হাজার ৫৭২ কোটি এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে ৭১২ কোটি টাকা। এছাড়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২ হাজার ২৯৫ কোটি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৮২১ কোটি, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ২১ হাজার ৬২১ কোটি, রেল মন্ত্রণালয়ে ১৮ হাজার ৯৪৭ কোটি, বিদ্যুৎ বিভাগে ২৬ হাজার ৬৬৭ কোটি, স্বাস্থ্য শিক্ষায় ৭ হাজার ৪৯৮ কোটি এবং সেতু বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৮০২ কোটি টাকা ব্যয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, আশা করছি আগামী বছরে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক থাকবে। ব্যবসা বাণিজ্যের গতি আরো বাড়বে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভালো হচ্ছে, যা আরো বাড়বে। আমদানি-রপ্তানিতেও গতি ফিরছে। ফলে ধরে নেয়া হচ্ছে, অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। এসব দিক বিশ্লেষণ করে আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধিও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হবে-এমনটি আশা করছে অর্থ বিভাগ।

অর্থ বিভাগের নির্দেশনায় বলা হয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সম্পদের ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত ব্যয় পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে দারিদ্র্য নিরসন, নারী উন্নয়ন ও জলবায়ু সংক্রান্ত কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক পরিকল্পনা ব্যয়সীমা ২০২২-২৩ নির্ধারণের পাশাপাশি ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়সীমা নিরূপণ করতে হবে।

রাজস্ব আহরণের প্রসঙ্গে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যমেয়াদি কী পরিমাণ সম্পদ পাওয়া যাবে, এ সম্পর্কে আগাম ধারণা দিতে হবে প্রস্তাবে। এই সম্পদের ওপর ভিত্তি করে বাজেট কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে। সেখানে আরো বলা হয়, ব্যয় প্রণয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। কারণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সহায়তা কমলে ব্যয় বাড়বে, তেমনই বৈদেশিক সহায়তা বাড়লে ওই মন্ত্রণালয়ের ব্যয় কমবে।

এদিকে প্রতি মুহূর্তেই করোনা মহামারির সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নতুন বিধিনিষেধও জারি করা হয়েছে। এসব বিষয়কেই আসন্ন বাজেটে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App