×

মুক্তচিন্তা

রেমিট্যান্সে থাবা : হুন্ডিতে বাহবা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২২, ০১:১৯ এএম

রেমিট্যান্সে আরো কিছু প্রণোদনা ঘোষণায় প্রবাসীদের সুখবরের মাধ্যমে শুরু হয়েছে নতুন বছরটি। চলতি জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশের ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ প্রবাসী বাংলাদেশিদের কেউ ১০০ টাকা দেশে পাঠালে এর সঙ্গে দুই টাকা ৫০ পয়সা যোগ হয়ে তার স্বজনরা পাবেন ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, রেমিট্যান্সে সরকারি প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ‘নববর্ষের উপহার’। উপহারটির সুবাদে হুন্ডিসহ অবৈধ পথে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর প্রবণতা কমবে, সেই আশা করাই যায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। কমবে মানিলন্ডারিং। এই আশায় ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা চালু করে সরকার। এরপরও হুন্ডিসহ অবৈধ নানা পথে দেশে টাকা পাঠানোর ক্রিয়াকর্ম চলতেই থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল এটি ৩ শতাংশ করার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের শীর্ষ খাতের একটি প্রবাসীর পাঠানো অর্থ। অর্থনীতির ভাষায় এটি রেমিট্যান্স। এই ইংরেজিটির অর্থসহ তরজমা গাঁওগঞ্জের নিরক্ষর মানুষও জানে। রেমিট্যান্স পাঠানো মানুষের সংখ্যা ১ কোটির বেশি। সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালে সারা বিশ্বে কাজ করা এই প্রবাসীরা বাংলাদেশে ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এখন কেন উল্টা গতি? গোলমালটা অন্যখানে। তাদের এই টাকা করমুক্ত ঘোষণা করা হলেও দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা প্রবাসীদের টাকায় কমবেশি থাবা পড়ছে সরকারের। সেটা করা হচ্ছে এক্সাইজ ডিউটির নামে। তাও বেশ কৌশলে। অনেক প্রবাসী এই ফ্যারকা এত বোঝেনি। বোঝার গরজও করেনি। খোঁজও রাখেনি অনেকে। ঘটনাচক্রে সর্বসাকুল্য টাকার অঙ্ক মেলাতে গেলে কখনো কখনো তা জানার আওতায় আসে। তারা বা স্বজনরা খোঁজ নিতে গেলে ব্যাংক থেকে দায় চাপিয়ে দেয়া হয় সরকারের ওপর। বলা হয়, ব্যাংক কেবল সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে মাত্র। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে এ সংক্রান্ত মেসেজ পেয়েছেন। এতে অ্যাকাউন্ট থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা কেটে রাখার বিষয়টি আগের মতো আর চাপা থাকছে না। বিষয়টি উদ্বেগের সঙ্গে আচ্ছা রকমের বিভ্রান্তিও তৈরি করছে। নানান আজেবাজে কথা রটছে। রটানো হচ্ছে। সরকারের ওপর ক্ষেপছে প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। সরকার যেখানে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ শুল্কমুক্ত ঘোষণা করেছে, সেখানে কেন টাকা কেটে রাখা হচ্ছে? কেন এই সাংঘর্ষিক অবস্থা? প্রশ্নটি নিষ্পত্তিহীন। তবে ফলাফল বোধগম্য। এটি হুন্ডি ও অবৈধ পথকে নতুন করে উৎসাহ জোগাচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। বছরে দুবার (একবার জুনে এবং আরেকবার ডিসেম্বরে) এ টাকা কেটে রাখা হয়। ব্যাংকাররা বলছেন, এটা সরকারের রেভিনিউ জেনারেট করার একটা প্রসেস। অনেকটা হিডেনে বা নিঃশব্দে করা হয় কর্মটি। ২০২০-২১ সালের অর্থবছরের বাজেটে এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। ১ লাখ টাকা পর্যন্ত কাউকে এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। তবে ১-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং ১০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট বছরে কোনো একটা সময় কারো অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলে (বছর শেষে ৫০ হাজার টাকা থাকলেও) ৩ হাজার টাকা এক্সাসাইজ ডিউটি কাটা হয়। আর ১-৫ কোটি টাকার জন্য কাটা হয় ১৫ হাজার টাকা। ৫ কোটি টাকার বেশি হলে এক্সাইজ ডিউটি ৪০ হাজার টাকা। একদিনের জন্য কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা থাকলেও সেই গ্রাহককে ৩ হাজার টাকা গুনতে হবে। এ কর্মযজ্ঞটি হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইন্টারনাল রিসোর্স ডিভিশন-আইআরডির তদারকি ও নির্দেশনায়। এখানে ব্যাংকের কোনো আয় নেই। ব্যাংক স্রেফ সরকারের কালেক্টর। ধীরে ধীরে হলেও প্রবাসী ও তাদের পরিবারের কাছে এটি এখন অনেকটা পরিষ্কার। মাসখানেক ধরে রেমিট্যান্সে খরার টান পড়ার অন্যতম কারণ বা রহস্য এখানেই। মাস কয়েক ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কেবল কমছেই। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে হালে রেমিট্যান্স কম প্রায় সাড়ে ২১ শতাংশ। এর হেতু খুঁজতে গিয়ে আঙুল যাচ্ছে হুন্ডির দিকে। এ বিষয়ে জানা বোঝা মহল বলছে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় প্রবাসী আয় অবশ্যই বেড়েছে। এর চেয়ে বেশি বেড়েছে হুন্ডির প্রবণতা। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলের দিকে কম যাচ্ছেন প্রবাসীরা। ব্যাংকিং চ্যানেলে না এলে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার অঙ্ক বের করার কোনো পথ থাকে না। অথচ করোনার ভর সময়েও বিস্ময়করভাবে দেশে প্রবাসী আয়-রেমিট্যান্সে এত খরার টান পড়েনি। তা শক্তি জুগিয়েছিল স্থবির অর্থনীতির ধমনিতে। পাল্টা বিস্ময় চলছে করোনা পরিস্থিতি ভালোর দিকে চলতে শুরু করার পর। হুন্ডি বাজারের কারবারিরা একে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এমনিতেও কম আয়ের প্রবাসীদের মধ্যে হুন্ডিতে ঝোঁকার প্রবণতা বেশি। তার ওপর ট্রেড এক্টিভিটিস (বাণিজ্যিক কার্যক্রম) বেড়েছে। ট্রেড এক্টিভিটিস বাড়ায় আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে অবৈধ লেনদেনও বেড়েছে। এই পুরো অসুস্থ দৌড়ে লাগাম টানা কঠিন। তবে, প্রবাসী আয়ে যথাসম্ভব স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। তা করতে গেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশে পাঠানোর খরচ কমানোর বিকল্প নেই। এ নিয়ে তবে, কিন্তু, যদির অবকাশ রাখা যাবে না। লুকোচুরি-চাতুরিও কাম্য নয়। বহু আগেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সংক্রান্ত কঠোর নির্দেশনাও ছিল তার। প্রবাসীসহ দেশের বেশিরভাগ মানুষ এতে খুশি হয়েছিল। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর হুকুমের উদ্ধৃতি দিয়ে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলে দিয়েছিলেন, দেশে টাকা পাঠাতে প্রবাসীদের কোনো খরচই লাগবে না। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকেই তা কার্যকর হবে। আদতে সেটা হয়নি। বরং জটিলতা, গোঁজামিল এমনকি চাতুরি বেড়েছে। প্রবাসীদের দেশে টাকা পাঠাতে কোনো খরচই লাগবে না ঘোষণা দেয়ার পর ২০১৮ সালের বাজেট বক্তব্যে পরিস্থিতি আরো তালগোল পাকিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সেও কি ভ্যাট দিতে হবে? এ নিয়ে মুহিতের ব্যঙ্গাত্মক ইমেজ-ভিডিও পর্যন্ত প্রকাশ হতে থাকে। বেগতিক অবস্থায় তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। এতে বলা হয়েছিল- ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর মূল্য সংযোজন কর-মূসক বা ভ্যাট আরোপ হয়নি। প্রবাসীরা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে যে কোনো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন। বিজ্ঞপ্তিতে অবৈধ চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়। আরো পরে বৈধ উপায়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনাও ঘোষণা হয়। তা পেতে ১ হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নীতিমালায় আরো কিছু দিক-নির্দেশনা ছিল। পরে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা হয়। নতুন বছরের ঘোষণায় সেটা করা হয়েছে আড়াই শতাংশ। বাজেটে এ জন্য টাকা বরাদ্দও রয়েছে। হুন্ডিওয়ালারা এ সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশে আরো পাকা। হুন্ডিতে দেশে টাকা পাঠালে ডলারের বিনিময় হারে তারা আরো বেশি দেয়। অন্য কোনো খরচ টানতে হয় না। সরকার নানা উদ্যোগ ও হুমকি দিলেও হুন্ডি চক্রকে স্পর্শ করতেও পারছে না। এদের রুখতে বৈধ পথে টাকা পাঠানোর খরচ আরো কমানো জরুরি। প্রবাসে বাংলাদেশি ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউস বাড়ানোর কথাও চিন্তা করা যায়। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট, বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App