×

মুক্তচিন্তা

রাজাকার তালিকাবহির্ভূত বাকি দেশবাসী মুক্তিযোদ্ধা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৫৬ এএম

১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কতিপয় বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী ছাড়া সমগ্র দেশবাসী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ঘোষিত ৩০ লাখের অনেক বেশি লোক শহীদ হয়েছেন, দুই লাখের অনেক বেশি মা-বোন ধর্ষিত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, যাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। অসংখ্য গণকবরের সন্ধান আজো মেলেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে। ধন-সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। বহু লোক চাকরিচ্যুত হয়েছে। ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগণেরই যুদ্ধ। তারাই লড়েছে। কোনো একটি রণাঙ্গনে নয়- সর্বত্র, সব রণাঙ্গনে, কেবল দেশে নয়, বিদেশেও। বলা হয়েছে, শতকরা ৮০ জনই ছিল কৃষক। এ কোনো অতিরঞ্জন নয়। গ্রামে-গ্রামে, প্রান্তে-প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধ। (ভোরের কাগজ, ২০.১১.২১)। সে সময় এক পাকিস্তানি বালুচ সৈন্য বলেছিল, এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনো জয়লাভ করতে পারবে না। আমরা বাংলাদেশের যে কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছি, কোথাও জনসাধারণের সামান্যতম সাহায্য বা সহযোগিতা পাইনি। সামান্য খাদ্য বা পানি চেয়েও পাইনি। দিলেও আমাদের মধ্যে অনেকে খাদ্য বা পানিতে বিষ মেশানো আছে সন্দেহ করে খায়নি। যে দেশে দেশবাসীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি এত ঘৃণা, ভয়, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস সে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কখনো জয়লাভ করা যায় না। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সে বলেছিল, বাঙালিদের আতিথেয়তা সম্পর্কে কত গল্প শুনেছিলাম। আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেকে এদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করে বাঙালি হয়েছে। জন হেস্টিংস নামক এক মিশনারি বলেছেন, ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ৬ লাখ কিংবা তার কাছাকাছি বা তার বেশিও হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসক ড. ডেভিড বলেছেন, এই সংখ্যা ৪ লাখ ৩০ হাজার। ড. এম হাসান বলেছেন, নতুন একটি জাতি সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই নীতি গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানিদের ঘোষিত নীতিই ছিল, পাকিস্তানি সৈন্যদের দিয়ে এ দেশের সব নারীকে ধর্ষণের মাধ্যমে গর্ভবতী করে নতুন পাকিস্তানি জাতির জন্ম দেয়া, যারা হবে খাঁটি পাকিস্তানি (গণহত্যা, রাষ্ট্র ও জাদুঘর- মুনতাসীর মামুন)। ‘নরসিংদী জেলার পলাশ থানার একটি গ্রাম, নাম নোয়াকান্দা। সেই গ্রামে বাস করত সুরুজ ভান নামের এক গৃহবধূ। সপরিবারে বাস করত। একদিন এক পাকিস্তানি সৈন্য ক্ষুধার্ত হয়ে তার কাছে কিছু খাদ্য চায়। ঘরে কিছু না থাকায় সুরুজ ভান সৈন্যটিকে একটি কাঁঠাল খেতে দেয়। কাঁঠাল খেতে খেতে সৈন্যটির নাকে, মুখে, গায়ে কাঁঠালের আঠা লেগে যায়। সৈন্যটি কাঁঠালের আঠা ছাড়াবার জন্য পানি চায়। সুরুজ ভান মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত এক বদনা পানি এনে দেয়। সে পানি সৈন্যটির হাত, মুখ, চোখে লেগে যাওয়ায় তার চোখ জ¦ালা করতে থাকে। সে কিছুই দেখতে পায় না। সুরুজ ভান এই সুযোগে তার রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে সৈন্যটিকে পেটাতে থাকে। সেই সঙ্গে যোগ দেয় পরিবারের নারী সদস্যরা। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা অনেক আগেই ভয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে।’ (একজন সাহসী মহিলার কথা : খুরশীদ জাহান। রহীম শাহ্ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ : পঁচিশ বছর, পৃ. ২৭৬) মা এবং মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষার্থে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সব বাঙালি কোনো পদক, খেতাব, প্রণোদনা, পুরস্কার বা স্বীকৃতির আশায় শত্রæর হামলা প্রতিরোধ করেনি। হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে জীবনের তোয়াক্কা না করে সবাই শত্রæ হত্যা করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার তাদের এই অপূর্ব ত্যাগের জন্য কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে পদক, খেতাব ও চাকরিতে পদোন্নতিসহ নানাবিধ প্রণোদনা দিয়ে মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু দেশের যে বিশাল জনগোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে হানাদার বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা তাদের ত্যাগের জন্য সামান্য স্বীকৃতিটুকুও পায়নি। এই বিরাট জনগোষ্ঠী তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি না পাওয়ায় তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। (এক যাত্রায় দুই ফল হয় না)। সুবিচারের অভাবে তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দেশের শত্রæরা তাদের এই ক্ষোভকে পুঁজি করে দেশবাসীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধার বিভাজন তৈরি করে গণঅসন্তোষের সুযোগ পায়। সুবিচারের অভাবই ঐক্যবদ্ধ জাতির পথে প্রধান অন্তরায়। জনগণের ত্যাগের স্বীকৃতি এবং সুবিচার একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে আটক বাঙালিরা শুধু বাঙালি হওয়ার অপরাধে আটক ছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবন্দিদের বিনিময়ে তাদের দেশে এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। ক্ষোভ তাদের মধ্যেও ছিল। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো অপশক্তি তার ক্ষতি করতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিশাল জনগোষ্ঠীর তালিকা করা কখনো বাস্তবসম্মত নয়। স্বল্পসংখ্যক রাজাকারের তালিকা করা অনেক সহজ ছিল। কিন্তু আমরা উল্টোপথে হেঁটেছি। গত ৫০ বছরেও আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করতে পারিনি। এখনো এই তালিকা প্রণয়নের প্রস্তুতি চলছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক ঘোষণা করেছেন, ’২২ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই রাজাকারের তালিকা প্রস্তুত হবে। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংসের গবেষণা অনুযায়ী রাজাকারের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। জেনারেল নিয়াজির বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ ছিল। স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের তালিকা উল্লেখ করা হয়।’ (ভোরের কাগজ, ০৪.১১.২১)। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের সংখ্যা অল্প থাকলেও এই সংখ্যা পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সহায়তায় তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। খেতাব ও পদকপ্রাপ্ত বহু মুক্তিযোদ্ধা স্বৈরশাসকদের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। অন্যান্য সুবিধাবাদীরা তো আছেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদিও তারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়েছিল, এখন তারা আর এসব ধ্বনি দেয় না। দীর্ঘ একুশ বছর এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। দেশপ্রেমের অভাবে এ সময়ের প্রজন্মের মধ্যে অমানবিক ভাবধারার মানসিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিথ্যাচারিতা এ সময়ে দেশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দেশপ্রেমের কথা নাগরিকদের ভুলিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে গ্রেনেড হামলা করে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ হয়রানি তো লেগেই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি বৃদ্ধির আরো অনেক কারণ রয়েছে। এরা জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে না, বাল্যবিবাহে উৎসাহী। একটি গোপনশক্তি অনৈতিক ও অবৈধ আর্থিক সুবিধা দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের দল ভারী করে। দেশের ক্রমবর্ধমান এই অপশক্তির মোকাবিলা করার জন্য তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাবে না। তাদের গতিরোধ করতে হলে শিক্ষাবিস্তার ঘটাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ইতিহাস সচেতন করে পক্ষশক্তির সংখ্যা বাড়াতে হবে। ঘোষিত রাজাকারদের তালিকার বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রত্যেক সনদপত্রে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ছবি’ এবং বাংলাদেশের ‘জাতীয় পতাকা’ অঙ্কিত থাকবে। এই সনদপত্র তাদের মধ্যে বিনামূল্যে প্রদান করতে হবে। সে সময়কার কোনো মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে না থাকলে তার বংশধরদের মধ্যে তা বিতরণ করতে হবে। এর ফলে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগরিত হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লাভের সুযোগ হবে। পিতৃপুরুষের মহান অবদানের কথা স্মরণ করে গর্ববোধ করবে। সৎ কাজের স্বীকৃতি সবাই চায়। এই সনদপত্র যদি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির কাছে যায় তাহলে ক্ষতির পরিবর্তে লাভই হবে। বাড়ির সদস্যদের ওপর অপরাধপ্রবণ মানসিকতার চাপ পড়বে। আজ থেকে ১৫ বছর পূর্বে আমি ‘ক্রেস্ট’ শীর্ষক একটি গল্প লিখেছিলাম। তাতে এক রাজাকারের নাতি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হয়। পুরস্কারস্বরূপ সে একটি ‘ক্রেস্ট’ পায়। ক্রেস্টের গায়ে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ছবি, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ও বাংলাদেশের ‘জাতীয় পতাকা’ অঙ্কিত ছিল। এই ক্রেস্ট নিয়ে রাজাকার পরিবারে যে প্রতিক্রিয়া হয় তার বর্ণনা ছিল। রাজাকারের নাতি তার সর্বশক্তি দিয়ে ওই ‘ক্রেস্ট’ রক্ষা করে। ‘সনদপত্র’ মর্যাদার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বর্তমানে সরকারের যে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে তার সামান্যতম অর্থও প্রস্তাবিত সনদপত্রের জন্য ব্যয় হবে না। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও সুশাসনের এজেন্ডার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরিতে তিনটি উপাদান জরুরি। প্রথমত, আমাদের ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, জনগণের আস্থাভাজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।’ (প্রথম আলো, ১২.১১.২১) আমার বিশ্বাস, ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র’ প্রাপ্তির ফলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠবে তা ড. রওনক জাহানের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তারও সমাধান হবে। শাহ্জাহান কিবরিয়া : শিশু সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App