×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ও ইতিহাসের ফিরে আসা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৫৬ এএম

আজ বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান ইতিহাসের বরপুত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে লন্ডন ও পরে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সমকাল ও মহাকালের মহানায়ক হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্ব এবং যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। যদিও ১৯৭৫ সালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যে পালাবদল ঘটেছিল, সে কারণে জনপরিসরে এ দিবস পালন করা বন্ধ ছিল। সেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকারের সময়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়নি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির ক্ষমতাসীন সময়কালকে অনেকে গণতান্ত্রিক সময়কাল বলে দাবি করলেও, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি সব আয়োজন করা হয়েছিল এ আমলেই। ফলে এ সময়কালেও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করেছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব এবং মর্যাদার সঙ্গে পালন করা শুরু হয়। নতুন প্রজন্ম নতুন করে জানতে শুরু করে কীভাবে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের কোন মাহেন্দ্রক্ষণে নিজ সোনার বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে ইতিহাসের সত্যকে সুরক্ষার একটা চর্চা এদেশে তখন থেকেই শুরু হয়। এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে পুনরায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইতিহাসের চাকা আবার উল্টো দিকে চলতে শুরু করে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীনের ৫০ বছর হয়েছে কিন্তু প্রায় ২৮ বছর (১৯৭৫-১৯৯০, ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৮) রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার বিরোধী শক্তি। ফলে ৫০ বছরের বেশিরভাগ সময় স্বাধীন বাংলাদেশের শাসন করেছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরের শক্তি। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, আদর্শ, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা, উপস্থাপনা এবং নতুন প্রজন্মের মনে-মননে সঞ্চারিত করার কোনো পরিসর সৃষ্টি হয়নি এ ২৮ বছর সময়কালে। কেবল আওয়ামী লীগের শাসনামলে (১৯৭১-১৯৭৫, ১৯৯৬-২০০১, ২০০৮-২০২২) বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে। আর এ সময়কালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটিও বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে, পালিত হয়েছে এবং উদযাপন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত যথাযথভাবে উপস্থাপন করা জরুরি, কেননা এর মধ্য দিয়েই নতুন প্রজন্ম জানবে মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিশালত্ব, নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা ও দক্ষতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নির্বিচারে হত্যা করেছিল এদেশের নারী-শিশু, আবাল-বৃদ্ধবনিতাকে, তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ৯ মাস বঙ্গবন্ধু বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এদেশের মুক্তিকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য মরণ-পণ যুদ্ধ করছিল, বঙ্গবন্ধু তখন বিচারের নামে প্রহসনের মুখোমুখি হয়ে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দেয়া হয়। ১২টি মামলার মধ্যে ছয়টি মামলার রায় ছিল মৃত্যুদণ্ড। এর মধ্যে অন্যতম একটি মামলা ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মনোবল একটুও টলাতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এদিকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সে হিম্মত ছিল না বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার। ফলে বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভোর রাতে একটি ফ্লাইট লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করে। ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছান। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর পেয়ে এডওয়ার্ড হিথ তার সফর সংক্ষিপ্ত করে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য দেশে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মাননা প্রদান করেন। তিনি তার ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানান এবং তিনি তার কার্যালয়ের বাইরে এসে নিজে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন। ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ করেন। ৯ জানুয়ারি সকালেই বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে লন্ডন থেকেই ফোন করেন এবং ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানিয়ে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু জানুয়ারির ৯ তারিখ দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন। বঙ্গবন্ধু যখন দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছান, তখন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানান। পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে আন্তরিক অভিনন্দন ও স্বাগত জানাচ্ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তখন বঙ্গবন্ধুকে তিন বাহিনীর প্রায় ১৫০ সদস্যের সমন্বয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় ভারতের মাটিতেই। ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানানো হয়। ভারতের বিরোচিত সংবর্ধনা শেষে ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে একটি বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মহান নেতা ফিরে আসেন তার নিজের জন্মভূমিতে; নিজের মাতৃভূমিতে। বিমানবন্দর ও রাস্তার দুই পাশে লাখো উৎসুখ জনতা পিতার প্রত্যাবর্তনে বিপুলভাবে আপ্লুত। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে মুখরিত হলো বাংলার আকাশ-বাতাস। বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতাকে গভীর ভালোবাসায় বরণ করে নেন। বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, সেখানে আগে থেকেই লাখো জনতা অপেক্ষা করছিল ইতিহাসের বরপুত্রকে বরণ করার জন্য, এক নজর দেখার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর কথা শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু ৩৫ মিনিট রেসকোর্স ময়দানে বক্তব্য রেখে বাড়ি ফিরেন নিজের পরিবারের কাছে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এ ঐতিহাসিক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কোন চক্রই ইতিহাসের এ সত্যকে মুছে ফেলতে পারবে না। সাময়িকভাবে হয়তো ইতিহাসের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে কিন্তু ইতিহাসে সত্য তার নিজ গুণেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক ঘটনার অনুপুক্সক্ষ জানার মধ্য দিয়েই নতুন প্রজন্ম আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন। বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন জানাটা খুবই জরুরি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App