×

মুক্তচিন্তা

শেখ হাসিনা সরকারের বর্ষপূর্তি > ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় নির্বাচন : বিচিত্র ভাবনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ০১:৩৭ এএম

গত ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতার তৃতীয় বর্ষপূর্তি করল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগই পরপর তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড সৃষ্টি করল। আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে এ দিন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি তার সরকারের সাফল্য, উন্নয়ন, অগ্রগতি, করোনা মহামারির মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং সর্বোপরি দেশ-বিদেশে সরকারবিরোধী নানা রকমের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। তিনি তার ভাষণে বলেন : ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। দেশ-বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাই নানা ষড়ডন্ত্র করছে এই অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার জন্য। মিথ্যা-বানোয়াট-কাল্পনিক তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। বিদেশে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।’ জননেত্রী শেখ হাসিনার এ ভাষণ বাস্তবোচিত এবং সময়োপযোগী সন্দেহ নেই। সত্যিই দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা গোষ্ঠীটি দেশ-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা ঘটনা পরম্পরায় সেই চিত্র মাঝেমধ্যে আমরা দেখতে পাই। সুতরাং এ সব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীকে সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে হবে দেশপ্রেমিক নাগরিকদেরও। তবে সাংগাঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে কেবল সচেতন হলেই চলবে না- দায়িত্বশীল ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে হবে। দুঃখজনক, অনেক সময়ই আওয়ামী লীগ বিভিন্ন বিষয়ে উদাসীনতার পরিচয় দেয়- দলীয় আন্তঃশৃঙ্খলা ও সংহতির পরিচয় বিনষ্ট করে ফেলে। সাম্প্রতিক কালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশব্যাপী স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ ঘোষণ করে প্রতিবাদ হিসেবে এই নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ থেকে বিএনপি বিরত রয়েছে। কিন্তু বিএনপির অনানুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ দেশের সর্বত্র, প্রায় সব ইউনিয়নেই। অর্থাৎ দলীয় প্রতীক ধানের শীষের বদলে নানা স্থানে হাতি, ঘোড়া, গরু, গাড়ি, ছাতা প্রভৃতি বিচিত্র সব মার্কা নিয়ে বিএনপির স্থানীয় নেতা ও কর্মীরা ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন- বিজয়ীও হয়েছেন অনেক স্থানের অনেক পদে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলেও অনেক স্থানে ‘বঞ্চিত’রা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন- বিদ্রোহীরাও বিভিন্ন স্থানে বিজয়মাল্যে ভূষিত হয়েছেন। আগামীতে যেসব ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আশা বা আশঙ্কা করা যাচ্ছে তারও অনেক স্থানে বিদ্রোহীদের জয় নিশ্চিত হবে, পক্ষান্তরে দল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীর পরাজয় ঘটবে। সরকারি দলের ‘মনোনীত’ প্রার্থীদের ভূমিধস পরাজয়ে আমাদের মনে খানিকটা খটকা লাগে। খটকা লাগে এই ভেবে যে, তাহলে তৃণমূল পর্যায়ে প্রার্থী বাছাইকালে দলের যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের মনোযোগ কিংবা স্বচ্ছতার অভাব ছিল! অভাব ছিল জনমত যাচাইয়ে দক্ষতারও। সার্বিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন অযৌক্তিক কিছু নয়! স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা সে প্রশ্নকে প্রকৃতপক্ষে গভীরতাই দান করে। এরূপ অবস্থায় আমরা ভাবতে বসেছি যে, তাহলে সরকারি দল ও দলের কর্মীরা কি তবে বিপরীতমুখী পথে হাঁটা শুরু করেছে! অথবা প্রকৃত ও ত্যাগী কর্মী চিনতে বা মনোনয়নের সুপারিশের মধ্যে কোথাও কোনো ফাঁক আছে? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যদি এ রকম পরিস্থিতি হয়, তবে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য কী চিত্র হতে পারে তা ভেবে সাধারণভাবেই আমাদের মনে অজানা এক শঙ্কা তৈরি করে বৈকি! অজানা আশঙ্কাও মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে যে জাতীয় নির্বাচন আসন্ন বলে আমাদের হিসাব তা আওয়ামী লীগের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক হতে যাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনী হালচাল দেখে সে প্রসঙ্গও মনের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দলের ঐক্য বজায় রাখতে এখনো আমরা সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরা কতটা মনোযোগী আছেন তা ভেবে দেখাও সময়ের অনিবার্য দাবি বলে মনে করি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে। বিগত তিনটি মেয়াদে পরপর টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার ফলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত আছে। বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে একের পর এক মেগা প্রকল্প। জাতীয়ভাবে সক্ষমতা অর্জনও সম্ভব হয়েছে আমাদের। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার এটি যেমন একটি ইতিবাচক দিক তেমনি আবার দলের বা সরকারের ভেতর এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বও তৈরি হয়েছে। এরা নানাভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে এদের বিতর্কিত ও অসৎ কর্মকাণ্ডে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি মাঝেমধ্যে ক্ষণ্ন হয়ে থাকে। সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও কী এক রহস্যজনক কারণে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে দৃশ্যমান সাফল্য সাধারণের সম্মুখে তুলে ধরতে পারেনি। দল ও সরকারের কোনো মহলের একেবারে ভেতর প্রান্তে ঘাপটি মেরে বসে থেকে সুবিধাভোগীরা নিজেদের ‘আখের’ গোছানোই সম্পন্ন করছেন! আওয়ামী লীগের অনেকের কর্মকাণ্ডে মাঝেমধ্যে আবার এ রকম একটা ভাবও পরিলক্ষিত হয় যেন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে থাকতে তারা যারপরনাই ক্লান্ত! এখন কোনো রকমে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারলেই বাঁচি আর কি! তাই অনেকের মধ্যে লাগামহীন দুর্নীতি, সীমাহীন উদাসীনতা, মাত্রাহীন অজ্ঞানতাসুলভ কথাবার্তার ফুলঝুরি দেখা যায়! টেলিভিশনের ক্যামেরাই কারো কারো কাছে দেশ উদ্ধারের একমাত্র মাধ্যম ও বাহন হয়ে ওঠে! আওয়ামী লীগ টানা এক যুগের অধিক সময় ক্ষমতায় আছে বলে দেশ আজ একটি সুনির্দিষ্ট পথরেখায় সচল রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন ক্ষমতালোভী এবং পরাজিত গোষ্ঠী তা সহজে মেনে নিতে পারেনি। তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে প্রজন্মের মনে এক উদ্ভট রকমের আদর্শের সঞ্চার করা হয়। এক ধরনের উন্মূল জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতাপুষ্ট প্রজন্ম তৈরিতে মনোযোগ দেয়। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে দেশে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয় একমাত্র সেজন্যই বাংলাদেশ প্রায় শতবর্ষ পেছনে পড়ে যায়! কিন্তু পেছনে পড়া বাংলাদেশকে টেনে তুলে এনে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শুধু পেছনে পড়া বাংলাদেশকে সামনের দিকেই নিয়ে চলেছেন এমন নয়- আত্মমর্যাদার সঙ্গে, জাতীয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন। এগিয়ে চলেছেন আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়নের উদ্যমী প্রেরণা সঞ্চারের মাধ্যমে। তিনিই আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ’ বাংলাদেশের। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রার যেমন সহযাত্রী তেমনি ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার স্বাপ্নিক অভিযাত্রার সহযাত্রী। কিন্তু ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ’ বাংলাদেশের অভিযাত্রায় মাঝেমধ্যে হোঁচট খাই, বিভ্রান্ত হই! দলীয় কিছু নেতাকর্মীর অবিমৃশ্যকারী আচরণে আমাদের মনে সেই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ্যে স্থির থাকা অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। অবিমৃশ্যকারী এসব নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট ঘটনা-দুর্ঘটনায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির তৎপরতাও আলোচনায় আসে। সাংগঠনিক পর্যায়ের দুর্বলতা থেকে থাকলে জাতীয় নির্বাচনের আগেই তা কাটিয়ে উঠতে হবে। জাতীয় নির্বাচনে যদি স্থানীয় নির্বাচনের সামান্য প্রভাবও দেখা যায় তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যেমন অস্বস্তি ও লজ্জার মধ্যে পড়বে তেমনি আমাদের দেশটিও একটি বিপজ্জনক অবস্থার মুখোমুখি হবে। যে বিপজ্জনক অবস্থা আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর কালে দেখেছি তার চেয়ে ভয়ংকর পরিণতিই হয়তো দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হতে পারে। আর সেই সঙ্গে ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে, দলটির অসংখ্য নেতাকর্মীকেও। সুতরাং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও দলীয় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগকে এখনি মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে যা হওয়ার হয়ে গেছে, তার কোনো আঁচ যেন জাতীয় নির্বাচনকে স্পর্শ করতে না পারে সেজন্য দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদের মনোযোগ দিতে হবে প্রথমত ব্যক্তি-স্বার্থ, দ্বিতীয়ত দলীয় স্বার্থ, তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় স্বার্থে। রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাখতে হলেও আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের সব নেতা ও কর্মীর একসঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না, উচিতও হবে না। পাশাপাশি, বিরোধী গোষ্ঠীর তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ষড়যন্ত্র ও তার প্রচারণার ধরন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জানতে হবে। আর সেসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার কৌশলও আয়ত্ত করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। তা না পারলে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে’ চলা সম্ভব হবে না। শেখ হাসিনার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে প্রতিটি নেতাকর্মীকে আরো চৌকস হতে হবে, প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত করতে হবে দুরন্ত ও দুর্বার গতি। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App