×

মুক্তচিন্তা

আসুন এই সময়কে উপভোগ করি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ০১:৩৭ এএম

অবশেষে সে এসেই গেল। করোনা। বাসা গাড়ল আমার শরীরে। টের পেয়েছিলাম করোনার আগমনবার্তা। এ যেন ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে। আমি সেলেব নই, কাজেই সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনার আলো পেতে আনাংলা ঘোষণা দিয়ে আহা উহু শুনতে রাজি নই। কিন্তু করোনা প্রাণ নিয়েছে অনেক। অনেকেই পৃথিবী ছেড়েছেন সময়ের আগে। ফলে করোনা পজিটিভ শুনে হড়কে যাবে না এমন বীর কমই আছে। মনের মধ্যে খালি খচখচ এবার তবে কি আমার পালা? অস্ট্রেলিয়া থেকে পেনডেমিক বিশেষজ্ঞ বার্তা দিলেন- আপনি সৌভাগ্যবান। ওমিক্রন আপনাকে সারাজীবনের জন্য সুরক্ষা দেবে। ৫/৭ দিন। তারপর ইমিউন। যতই বলুন দুবছর ধরে গোটা দুনিয়াটাকে উথাল-পাথাল করে দিচ্ছে যে ভাইরাস-ত্রাস, তাকে উপেক্ষা করি কী করে? পত্রিকা যত পড়ি শুধু বিভ্রান্ত হই। এই বিশেষজ্ঞ আর বিজ্ঞানীদের অজস্র পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন পড়ার পরেই মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে, মাঝে মধ্যে পেটটাও গুড়গুড় করে ওঠে। দুদিন আগে কাগজে হৈ হৈ করে বেরোল যে এই ভাইরাসটি নাকি মনুষ্য প্রজাতিকে বাঁচানোর জন্য স্বয়ং ঈশ্বরের উপহার। এই ভাইরাস রথের মাঠে হারিয়ে যাওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার যমজ ভাই, বড়জোর ৪/৫টি দিন শরীরে নাড়াচাড়া করে সুবোধ বালকের মতো নিজেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। ফুসফুস আক্রান্ত হবে না তাই শ্বাসকষ্টের কেস নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে মজুত রাখার প্রয়োজন নেই, অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য হাসপাতালেও ফোন করতে হবে না। লাল-নীল-সবুজ কোনো ভলান্টিয়ার ডাকার প্রয়োজন নেই। অতি-সুভদ্র ভাইরাস এই ওমিক্রন তাই প্রণম্য। প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় আমাদের যেমন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয়েছিল, অসহায় আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছিল আকাশ বাতাস, একটার পর একটা গঙ্গাপ্রাপ্ত বেওয়ারিশ লাশ ভেসে আসছিল গঙ্গারই পাড়ে, এবার সেই বীভৎসতা নেই। হু হু করে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা, যেন বান ডেকেছে ভরা কোটালের, তবু হাসপাতালের বেডের জন্য হাহাকার নেই, মৃতের সংখ্যাও নগণ্য। মৃত্যুভয় প্রায় নেই বলে মানুষ আগের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিতে। এদের বক্তব্য একবার ওমিক্রন হলে শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এত বেড়ে যাবে যে তারপরে কোনো ভাইরাসই আর সুবিধা করে উঠতে পারবে না। হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে মানুষের সঙ্গে লড়াইয়ে ভাইরাসের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী যার অর্থ স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাবর্তন। আর একটি খবরে পড়লাম ফ্রান্সে ভাইরাস বাবাজীবনের আর এক নতুন অবতারের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যার পোশাকি নাম আই এইচ ইউ। এই ভাইরাসটি এ পর্যন্ত ৪৬ বার মিউটেট করেছে, হঠাৎ সে শ্রীমান ভয়ংকর হয়ে উঠবে না সেই গ্যারান্টি কোথায়? তার মানে ওমিক্রনেই ভাইরাসের ইতি এখনই এতটা আশাবাদী হওয়া মূর্খামি। ভাইরাস-রহস্য ভেদের নানাবিধ ব্যাখ্যার বেশিরভাগটা আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়, যেটুকু মরমে প্রবেশ করে সেটা যথেষ্ট অস্বস্তির। এই যেমন গতকালই টিভিতে এমন একটা খবর দেখলাম যা সত্য হলে সমূহ সর্বনাশ। ওই রিপোর্টের মূল কথাটি হলো ভারতবর্ষে অচিরেই দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা হবে ১৬-২০ লাখ। সংক্রমিত প্রতি ১০০ জনের মধ্যে দুজনেরও যদি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে প্রয়োজন হবে ৬০ হাজার বেডের। এত সংখ্যক বেড আমাদের দেশেই নেই। কিন্তু এত দ্রুত ছড়াচ্ছে কেন? সরকারি সিদ্ধান্ত ও মানুষের বেপরোয়া মানসিকতার জন্য। দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তিন গুণ গতিতে ছড়াচ্ছে ওমিক্রন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গোটা বড়দিনের ছুটিতেই নৈশ কার্ফু শিথিল করে ভিড়ে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশে প্রথম ওমিক্রনের সংক্রমণ পাওয়া যায় ১২ ডিসেম্বর। দুজনের শরীরে কোভিডের এই নতুন রূপ পাওয়া গেছে। দুজনই বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট দলের সদস্য। সম্প্রতি জিম্বাবুয়ে সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন তারা। করোনার নয়া স্ট্রেন নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এই পরিস্থিতিতে আর কতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন চালু রাখা যাবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন তিনি। ফের অনলাইনেই পড়াশোনার ইঙ্গিত দিলেন তিনি। এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনা ভাইরাস মহামারির ছোবল অনেকটাই সামলে নিতে পারলেও যে কয়েকটি দেশ বেশি সময় ধরে ধুঁকছে তার একটি বাংলাদেশ; সংক্রমণের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরা এখানকার লোকজনের একটি বড় অংশই বাইরে মাস্ক পরতেও চাচ্ছেন না। মাস্ক না পরার পেছনে নানা অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন তারা, আবার না পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে ক্ষেপে উঠছেন কেউ কেউ। চার মাসেও মহামারির প্রকোপ না কমার মধ্যে গেল সপ্তাহেই ঘরের বাইরে সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে সরকার। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে পুলিশসহ কার কী ভূমিকা হবে সে বিষয়েও বলা হয়েছে। তারপরও ‘মাস্ক পরলেই কি করোনা ভাইরাস ঠেকানো যাবে?’, ‘মাস্ক পরলে দম বন্ধ হয়ে আসে’, ‘মাস্ক পরলে বিরক্ত লাগে’- এমন নানা অজুহাতে মাস্ক ছাড়াই ঘর থেকে বের হয়ে পড়ছেন নাগরিকরা। মাস্ক পরা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবেন যারা সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ‘মানবিক উপায়ে সংযোগের’ মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করার কথা বলছেন। এই পরিস্থিতিতে মাস্ক পরার গুরুত্ব তুলে ধরে এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাতেও জনগণ সাড়া না দিলে আইন প্রয়োগে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না বলে মনে করছেন তারা। গত মার্চে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর টানা দুই মাস সরকারি ছুটি ঘোষণার সঙ্গে বাইরের সব ধরনের কাজকর্ম ও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এরপর বিধিনিষেধ শিথিল করার ধারাবাহিকতায় এখন অনেকটা আগের মতোই সব কিছু চলছে। তবে মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাসহ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। দেখুন, ভাইরাসের নামকরণের প্রক্রিয়াটি কিঞ্চিৎ জটিল। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞানীরা এই কাজ করে থাকেন। করুন। আমি বুঝতে পারি না নতুন ভাইরাসের দেখা মিললে একমাত্র গ্রিক ভাষার উপরেই নির্ভর করা হয় কেন? ডেল্টা গ্রিক, ওমিক্রনও তাই। একবিংশ শতকের ভাইরাসের নাম অনুসন্ধানে সৃষ্টির আদিতে এভাবে বারবার ফিরে যাওয়া? কোভিড ভাইরাসের সঙ্গে তিন বছর লুকোচুরি খেলছি, কখনো ধরা পড়িনি। এই পড়লাম। শরীরটা ভালোই বিগড়েছে, গায়ে জ্বর, কাঁপুনি, প্রচণ্ড দুর্বলতা। হয় যদি তাহলে কোনটা হবে, ডেল্টা না ওমিক্রন? প্রথমটা হলে হলো কেননা আমার গুচ্ছের কো-মর্বিডিটি আছে। তেমন হলে হয়তো হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে। ওমিক্রন হলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। চারদিকের ব্যাপার স্যাপার লক্ষ করে যেটুকু বুঝতে পারছি, ওমিক্রন সস্তায় পুষ্টিকর। ডেল্টার তুলনায় নেহাতই অলস, শরীরে প্রবেশ করে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় না। সবচেয়ে বড় কথা ফুসফুসের প্রতি ওমিক্রনের বিশেষ দুর্বলতা নেই। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা নেই, তার মানে বেলাগাম খরচও নেই। ওমিক্রন ক্ষণিকের অতিথি, একবার এলে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে না। হালকা কষ্ট দু’তিন দিনের। কিন্তু কী হবে কী হবে ভেবে লাভ নেই। বরং কিছু লেখা যাক। করোনাক্রান্তি সময়ের সালতামামি। এই সময়কে উপভোগ করে কিছু লেখা যাক। ওই একটা কাজই তো করতে পারি। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App