×

সারাদেশ

দৌলতপুরে দরবার শরিফে গ্রামবাসীর হামলা, আহত ১০

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ১১:১৪ এএম

দৌলতপুরে দরবার শরিফে গ্রামবাসীর হামলা, আহত ১০

দৌলতপুর উপজেলার কল্যাণপুর দরবার শরিফের প্রধান গেটের সামনে ভাঙচুর করে বিক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী। ছবি: ভোরের কাগজ

দৌলতপুরে দরবার শরিফে গ্রামবাসীর হামলা, আহত ১০

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের সেই আলোচিত দরবার শরিফে দফায় দফায় হামলা চালিয়েছেন বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। আশপাশের গ্রামবাসী এক হয়ে দরবার শরিফে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় সেখানকার কয়েকটি স্থাপনায়। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন কমবেশি আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) বিকেল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত উত্তেজিত গ্রামবাসী এ ঘটনা ঘটান। খবর পেয়ে পুলিশ, র‍্যাব ও ফারার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ঠিক কী কারণে হঠাৎ করেই গ্রামবাসী উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ।

স্থানীরা একাধিক সূত্র জানায়, দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের কল্যাণপুর চরদিয়াড় এলাকায় অবস্থিত নিজের দরবার শরিফে সেখানকার 'পীর' সৈয়দ তাছের আহমেদের ফিরে আসার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে এলাকায় এই গুজব চলতে থাকে। গত বছরের মাঝামাঝি ওই দরবার শরিফের খাদেম রাশেদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাছের 'পীর' নিজের দরবার শরিফের ভেতরে ঘটে যাওয়া ওই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি।

শুক্রবার কথিত পীর সৈয়দ তাছেরের দরবারে ফেরার গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে দরবার শরিফের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ লোকজন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সেখানে প্রথম দফা হামলা চালান। এ সময় বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী তাছের 'পীরকে' খুঁজতে থাকেন। কথিত পীর সৈয়দ তাছের আহমেদ দরবারের ভেতরে অবস্থান করছেন- এমন ধারণা করে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী দরবার শরিফের প্রধান গেটসহ সীমানা প্রাচীর ভেঙে চারদিক থেকে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারা সেখানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন কয়েকটি অাধাপাকা ঘর। এ সময় দরবার শরিফের সংরক্ষিত জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়। বিক্ষুব্ধদের হামলার সময় প্রাণভয়ে দরবারের নিরাপত্তাকর্মীরা পালিয়ে যান। এ ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ, র‍্যাব ও ফারার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই সন্ধ্যার পরে ফের দ্বিতীয় দফায় দরবার শরিফে হামলা চালান জোটবদ্ধ গ্রামবাসী। তারা নতুন করে ভাঙচুর ও স্থাপনাসহ মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেন। এই তাণ্ডবের সময় ফের দরবার শরিফের জিনিসপত্র লুটপাটের ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়। দফায় দফায় এই হামলার ঘটনায় অন্তত ১০ জন কমবেশি আহত হন। তাদের মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য গ্রামবাসীকে নিবৃত করতে হিমশিম খান। ভেড়ামারা উপজেলা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় পরপর দুই দফায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ ঘটনায় আলোচিত দরবার শরিফটি ধ্বংসস্তুতে পরিণত হয়।

চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির একপর্যায়ে হ্যান্ডমাইকে গ্রামবাসীকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানায় পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে গুলি ছোড়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু তারা পুলিশের কথাতেও পিছু হটেনি। তারা সেখান থেকে কথিত পীর সৈয়দ তাছের আহমেদের দরবার শরিফ উচ্ছেদের দাবিতে অনড় অবস্থানে থাকেন। পরে স্থানীয় হোগলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়ে হ্যান্ডমাইকের মাধ্যমে উত্তেজিত গ্রামবাসীকে সরে যেতে বলেন। চেয়ারম্যান তাদের দাবির সাথে একমত পোষণ করে দরবার শরিফ সিলগালা করে দেয়ার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কিন্তু চেয়ারম্যানের আশ্বাসও তারা মানতে চাননি। তখনো গ্রামবাসী দরবার শরিফের চারপাশে অবস্থান নিয়ে ঘেরাও করে রাখেন। টানা চার ঘণ্টা ধরে সেখানে তাণ্ডব চালানো হয়। পরে গভীর রাতে দৌলতপুর-ভেড়ামারা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াসির আরাফাত ও দৌলতপুর থানার ওসি এসএম জাবীদ হাসানসহ র‍্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় ফোর্স নিয়ে অ্যাকশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে গ্রামবাসীরা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।

এদিকে শুক্রবারের এই উত্তপ্ত ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় অপর একটি সূত্র জানায়, বিকেলে কথিত পীর সৈয়দ তাছের আহমেদের দরবার শরিফে ফিরে আসার গুজবীয় খবরে বহিরাগত ভক্ত-অনুসারীরা সেখানে ছুটে আসেন। তারা স্থানীয় এক মেয়েকে ইভটিজিং করেন। এতে প্রতিবাদ করতে গেলে তার অভিভাবককে মারপিট করা হয়। এ সময় তাছের 'পীরের' কথিত উপস্থিতির বলে শক্তিমান হয়ে স্থানীয় লোকজনদের উদ্দেশ্য করে তারা অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন। তাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডে কল্যাণপুর, চরদিয়াড়, সোনাইকুণ্ডি ও গাছেরদিয়াড়ের চারটি গ্রামের বিক্ষুব্ধ লোকজন দলবদ্ধ হয়ে তাছের 'পীরের' দরবার শরিফে দফায় দফায় এই হামলা, ভাঙচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেন। এ সময় তাছের 'পীরের' দরবার শরিফের বহিরাগত অনুসারীরাও দরবারের ভেতর থেকে পাথর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের ধাওয়া খেয়ে একপর্যায়ে তারা দরবার শরিফ থেকে দিগ্বিদিক পালিয়ে যান। এ ঘটনায় পুলিশ জাকির হোসেন নামে এক গ্রামবাসীকে আটক করেছে।

দৌলতপুর-ভেড়ামারা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াসির আরাফাত রাতে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তেজিত গ্রামবাসীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হার্ডলাইনে না গিয়ে আমরা তাদের শান্ত করার জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঠিক কী কারণে তারা হঠাৎ করেই এমন অগ্নিমূর্তি ধারণ করল তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুনরায় এ ধরনের সহিংস ঘটনা এড়াতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তদন্তের পর এ ব্যাপারে মামলা দায়ের করা হবে।

প্রসঙ্গত, দৌলতপুর উপজেলার কল্যাণপুর দরবার শরিফের ভেতরে গত বছরের ৬ জুন সেখানকার খাদেম রাশেদকে মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনায় দরবার শরিফের কথিত পীর সৈয়দ তাছের আহমেদসহ ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেন রাশেদের বাবা আব্দুর রাজ্জাক। এ মামলায় পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলেও অন্যতম আসামি কথিত পীর তাছের আহমেদসহ অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছেন। গত ১৭ অক্টোবর সৈয়দ তাছের 'পীর' তার বদলে নকল এক আসামিকে কুষ্টিয়ার আদালতে আত্মসমর্পণ করান। কিন্তু মামলার বাদী ও তার পক্ষের আইনজীবীরা তিনি আসল তাছের নন বলে শনাক্ত করেন। কথিত পীর তাছের আহমেদের বদলে নাজিম উদ্দিন নামে সেই ডামি বা নকল আসামিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করানোর ওই ঘটনা নিয়ে সে সময় জেলাজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App