×

মুক্তচিন্তা

সত্যিই তো, সচিবের স্ত্রী কি রিকশায় চলাচল করবেন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৭:৪৬ এএম

বছরের ঠিক শুরুতে একটা সত্য বেরিয়ে এলো। রাখঢাক করা গেল না কোনোমতে। কোনোভাবেই নয়। সত্যটা বের করলেন স্বয়ং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সিইও। মানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তার মুখ থেকেই বের হলো এবং তা একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে। খুব সতর্কতার সঙ্গে অপ্রিয় সত্যকে লুকিয়ে রাখলেও, তা আদতে লুকিয়ে রাখা যায় না প্রকৃতি মানুষকে সেই শিক্ষা দেয় ঘুরেফিরে। আবার কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে, সেটাও সত্য। যাই হোক, সত্যটা হলো, প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও সিইওর স্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় কোটি টাকা মূল্যের স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি) ব্যবহার করেন এবং তা ব্যক্তিগতভাবে। সিটি করপোরেশনের বিধি অনুযায়ী তা হওয়ার কথা নয়। পত্রিকার প্রতিবেদক জানতে চাইলে সিইও প্রতি উত্তরে বলেন, সচিবের স্ত্রী কি রিকশায় চলাচল করবেন। ঠিকই বলেছেন সিইও সাহেব এবং তিনি বাংলাদেশের আমলা সংস্কৃতির মতোই জবাব দিয়েছেন। সচিবের স্ত্রী রিকশায় চলাচল করবেন তা কি হয়। একটা স্ট্যাটাস তো আছে তার। তবে সাধারণ মানুষের কাছে কথাটা এমন শোনাল যে, সচিবের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকেই যেন এক এক খণ্ড সচিব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ভাব ও প্রবাহেই চলছে। পোশাকি ভদ্রতায় কমবেশি সবাই দেশপ্রেমিক, দায়িত্বপরায়ণ হলেও মনমানসিকতায় ভিন্ন, অন্যরূপ এবং বিপরীত। দায় ও দায়িত্বে বড় নয়, ভাবসাবে বড়। আমলাদের মাঝে অনেকেই এমন আছেন যে, যারা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করেন না, নিজের এবং পরিবারের প্রয়োজন বা চাহিদার আলোকে সব ব্যবস্থা নিজেদের অনুকূলে রাখেন, রাখতে ভালোবাসেন সেটাই আবার প্রমাণিত হলো। যদি সিইও জবাবে তার স্ত্রী কি রিকশায় চলাচল করবেন কথাটা না বলতেন তাহলে গাড়ি প্রসঙ্গে সংবাদ প্রতিবেদন সত্য, নাকি অসত্য সেই বিষয়ে পাঠকের ভাবনার একটা সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিংবা সিইও সংবাদ প্রতিবেদনের বিরোধিতা করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি জবাব দিয়ে ফেলেছেন সেহেতু সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য সত্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। এমন সচিবও আছেন যিনি এবং যার পরিবারের সদস্যরা সাধারণের মতোই জীবনযাপন করেন, চলাচল করেন। কেউ পরিচিত করে না দিলে তাদের আচরণ দেখে বিশ্বাস করার উপায় নেই যে তিনি সরকারের ঊর্র্ধ্বতন একজন কিংবা তিনি ঊর্ধ্বতনের পরিবারের একজন। সরকারি গাড়ি, বাড়ি, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সাধারণের মনে অনেক প্রশ্ন, সংশয়। যার পেছনে অনেক যৌক্তিকতা, দৃষ্টান্ত রয়েছে। তদ্রƒপ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জনগণকে সেবা প্রদান ও কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগের মাত্রা নিয়েও অনেক গল্প বাজারে চালু রয়েছে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ ও ওয়াসা নিয়ে। বিদ্যুৎ, ওয়াসার অবৈধ লাইন সংযোগ এবং এই বিষয়ে সিন্ডিকেটের সক্রিয়তা কত নগরবাসীকে যে নিঃস্ব করে দিচ্ছে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। আবার শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এডিস মশা নিধন, বস্তি ও হকার উচ্ছেদ দুই সিটি করপোরেশনের অন্যতম কাজ বলে অনেকেই মনে করেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা ওয়ার্ডের উন্নয়নের কাজ করেন। সেই কাজের ফলাফল কী হয় তা কমবেশি এলাকাবাসী জানেন। এডিস মশা নিধনে তেল ক্রয় নিয়ে কেলেঙ্কারি সেটা আর কারোর অজানা নয়। এমনকি বর্জ্য নিয়ে বাণিজ্যের কথাও সবাই জেনে গেছে। সম্প্রতি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ময়লাবাহী গাড়ি চালানো এবং প্রকৃত চালক দিয়ে গাড়ি না চালানোর পৃথক দুটি ঘটনায় সড়কে সাধারণ দুজন পথচারীর নির্মম মৃত্যু দুই সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরের অব্যবস্থাপনার কথাই বলে দেয়। এমন আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুই সিটি করপোরেশনের গাড়ি বিলাসিতা নিয়ে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন সাধারণ মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। সিটি করপোরেশনের বিধি অনুযায়ী সিইও প্রাধিকারভুক্ত হয়ে পেতে পারেন একটি কার (প্রাইভেটকার)। সেখানে তিনি ব্যবহার করছেন দুটি গাড়ি, যার একটি তিনি নিজে এবং অন্যটি তার স্ত্রী ও পরিবারের ব্যবহারের জন্য। পত্রিকায় প্রকাশ, এই দুটি গাড়ির পেছনে করপোরেশনের জ¦ালানি তেল খরচ মাসে প্রায় দেড় হাজার লিটার, যার এখনকার দাম প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে দুজন চালকের বেতন ও ভাতা ব্যয় তো রয়েছেই। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে, প্রাধিকার তালিকায় না থেকেও দক্ষিণ সিটির অন্তত ৪৫ জন ও উত্তর সিটির ৪১ জন কর্মকর্তা করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করছেন। ঊর্ধ্বতনের মতে, দায়িত্ব পালনে তারা গাড়ি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ গাড়ি ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। ভালো কথা। তো কী দায়িত্ব তারা পালন করছেন, তার ফলাফল কতটা ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা কি কখনো মূল্যায়ন করা হয়েছে কিংবা মূল্যায়ন করার প্রয়োজন বোধ করা হয়েছে, প্রশ্নটা কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই উদয় হয়। পদের মর্যাদার সঙ্গে যেমন গাড়ি যায়, ঠিক তেমনই প্রয়োজনের দাবি মেটাতে গাড়ি যায়। যাওয়া উচিত। কিন্তু সেটা বিধিবহির্ভূতভাবে কেন! প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের প্রয়োজনীয়তা পূরণে তো বিধি অনুযায়ী অনুমোদন লাগে, তাই না? নাকি অনুমোদন আগে, বিধি পড়ে? করপোরেশনই ভালো বলতে পারবে। দুজন বিচক্ষণ মেয়র দুই সিটি করপোরেশনে। অতীতের অনেক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতাকে তারা ক্লিন করতে সক্রিয় ছিলেন, এমনটাই জেনেছি। গাড়িবিলাসের বিষয়টিও নিশ্চয়ই অতীত থেকে চলমান একটি করপোরেশন সংস্কৃতি। তারাও নিশ্চয় চমকে উঠবেন। যা হয়তো বা তারা জানেন না কিংবা বুঝতে পারেননি। বিষয়টি আশা করি তাদের নজরে ও কঠোর ব্যবস্থাপনায় জায়গা পাবে। সিটি করপোরেশনের তো টাকার গাছ নেই। টাকা বানানোর ফ্যাক্টরিও নেই। সবই তো জনগণের টাকা। জনগণ তো সেবা পেতে বিল ও কর পরিশোধ করেন। সার্ভিস চার্জও দেন। এই টাকা দিয়েই তো করপোরেশনের সব কর্মকর্তার বেতন, ভাতা ও সুবিধাদি দেয়া হয়। আমার জানা নেই যে, অন্য কোনো সোর্স আছে কিনা। থাকলে তারও তো খরচের বিধি বা নিয়ম ও হিসাব থাকতে হয়। নাকি সব হিসাবই বেওয়ারিশ? বছরের শুরুতে একটা সংবাদ দেখে বুকটা শান্তিতে ভরে গিয়েছিল। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার হতে পেরেছে একজন শেখ হাসিনার কারণেই। দুর্নীতির অপবাদকে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দেশের নিজস্ব উদ্যোগেই পদ্মা সেতু নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। আজ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রায় শেষ সীমান্তে পৌঁছেছে। দেখলাম, সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতে শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে কিলোর পর কিলো হেঁটে আনন্দ উপভোগ করছেন। কুয়াশা মোড়ানো সেই নির্মল, স্নিগ্ধ পরিবেশ যেন তাদের আরো মহিমান্বিত করে তুলেছিল। মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন বেজে উঠছে প্রিয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি! আহা! এমন একজন নেতার দেশে কি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা দেশের সম্পদ রক্ষায় আত্মনিবেদিত হতে পারেন না? পারেন নিশ্চয়ই। মনমানসিকতার পরিবর্তন হলেই তো সব হয়, তাই না? স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App