×

মুক্তচিন্তা

মেট্রোরেলের প্রতীক্ষায়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৭:৪৬ এএম

গত বছরের শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পদ্মা সেতুর অগ্রগতি সরজমিন দেখতে যান। দুই বোন যে সময়ে ব্রিজে পা রাখেন বাংলাদেশের বহু মানুষই তখন বলতে গেলে নিদ্রাকাতর। তারা সেতুর উভয় পাশে চা খেয়েছেন। তারপর নিজের গাড়ি চড়ে ঢাকা ফিরেছেন। অবশ্য এটা তার চতুর্থবারের মতো পদ্মা সেতুর অগ্রগতি পরিদর্শন। এবারে এক পরিতৃপ্ত প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ফিরেছেন। নিশ্চিত হয়েছেন যে আগামী জুন মাসে এই সেতুটি সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার উপযোগী হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। আরো তৃপ্তির ব্যাপার এই যে, মোংলা বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রে দ্রুত সময়ে পৌঁছা যাবে এবং আমাদের নব-লব্ধ সামরিক ভূখণ্ডের অমূল্য রতনরাজি কাজে লাগানোর সুযোগ উন্মুক্ত হবে। সারাদেশের তথা দক্ষিণাঞ্চল বাঙালিদের জন্য তা হবে আয় উপার্জন বৃদ্ধির নিয়ামক এবং জাতীয় আয় ১-২ শতাংশ বৃদ্ধির হাতিয়ার। সবার সঙ্গে আমরা যারা ঢাকা শহরে বসবাস করছি বিশেষত উত্তরায় বসবাসে বাধ্য হয়েছি তাদের জন্যও শুভ সংবাদ জানা গেল একই দিনে। জানা গেল মেট্রোরেলের গড় কাজ ৭৩ ভাগ সমাপ্ত হয়েছে, তবে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ শতভাগ সমাপ্তির পথে এবং যা আগামী ডিসেম্বরের ১২ তারিখে সর্বসাধারণের ব্যবহার উপযোগী হবে। তার ভৌতিক অগ্রগতি বিচারে সেটা হয়তো অসম্ভবও নয়, কিন্তু দ্রুত চলাচল উপযোগীকরণে প্রধান বাধা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা- যা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আরো অনেক দিন চালিয়ে যেতে হবে। তবে আমার কাছে বড় সমস্যা মনে হচ্ছে যাত্রী প্রাপ্তি এবং তাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত প্রাপ্ত ভাড়া দিয়ে এই বিশাল আয়োজনকে বাঁচিয়ে রাখা। মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয় উত্তরার দিয়াবাড়ি; তার কার্যক্রম পশ্চাৎদেশ বা হিন্টার-ল্যান্ড বলতে বোঝাচ্ছে সারা উত্তরা, তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উত্তরা ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর সেক্টর। প্রথম তিনটি সেক্টর এখনো বলতে গেলে বিরানভূমি। এই সেক্টরগুলো সম্প্রসারিত উত্তরার অংশ। এখানে তেমন আবাসন গড়ে ওঠেনি, হবু বাসিন্দাদের সামর্থ্যটা ভিন্ন পর্যায়ে বিবেচ্য। সম্প্রসারিত উত্তরার এই এলাকার উন্নয়ন কাজ এখনো বলতে গেলে মধ্যম স্তরে রয়েছে। এলাকাটি মা, বাবা কিংবা অভিভাবকবিহীন। অতীতে এই এলাকাটি ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বছর তিনেক আগে ঘোষণা দিয়ে তাকে উত্তর সিটি করপোরেশনভুক্ত করা হবে বলে জানান দেয়া হয়। সর্বশেষ খবরে জানা গেল, উত্তরায় এই চারটি সেক্টর এখনো ‘নো ম্যানস ল্যান্ডস’ অর্থাৎ এলাকাটি ইউনিয়নভুক্তও নয় বা সিটি করপোরেশনভুক্তও নয়। এখনো তার উন্নয়নের দায়িত্ব রাজউকের হাতে। ইতোমধ্যে রাজউক বেশ কিছু অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টি করেছে। ১৮ নম্বর সেক্টর আংশিক ক্রিয়াশীল, অন্য তিনটি সেক্টরে আবাসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারকারীদের নামে বরাদ্দ দেয়া প্লটগুলো তেমন কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। পর্যাপ্ত নানাবিধ সুবিধার অভাবে পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজেএমইর প্রধান কার্যালয় ছাড়া অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত আবাসিক কাঠামো তেমন দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের ভৌতিক কাঠামো নির্মাণ হয়েছে ও অনেক সুযোগ-সুবিধার অভাবে প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রীর কিয়দাংশ ক্যাম্পাস পরিপূর্ণ ব্যবহার করছে। এলাকা ভরাটের কাজ বহু আগে সমাপ্ত হয়েছে, রাস্তাঘাটও কিছু কিছু হয়েছে। তবে নির্মিত রাস্তাগুলো খানাখন্দে ভরা। মূল একটি সড়ক অতি ব্যস্ত সড়ক। তার ওপর যানবাহনের চাপ এত বেশি যে প্রতি সপ্তাহে তার মেরামত প্রয়োজন। বর্ষাকালে মেরামতের প্রয়োজনীয়তা অধিক, তা না হলে পুরো এলাকা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। মেট্রোরেল নির্মাণ সহায়ক বড় বড় যানবাহনের কারণে মেরামতের কাজটা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ নেই। তা কোনো দিন হবে কিনা সে নিয়ে সন্দেহের দোলাচলে দুলতে হচ্ছে। রাস্তার পার্শ্ববর্তী ড্রেন কিংবা জল সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বহুদিন আগ থেকে বিদ্যুতের খাম্বা বসানো হলেও অতি সম্প্রতি তার সংযোগের কাজটি শুরু হয়েছে। ফলত রাতের বেলা পুরো এলাকাটি এখনো ভুতুড়ে এলাকা। এক সময় চোর-ডাকাত ও সমাজবিরোধীদের উৎপাত ছিল অনেক। এসব কারণে আবাসনের জন্য বণ্টনকৃত জমির ওপর গৃহাদি নির্মিত হয়েছে সামান্য ক’টি। বাড়িঘর নির্মাণের খরচ অন্য এলাকা থেকে বেশি হলেও বাড়ি ভাড়া ঢাকা শহরের অন্য এলাকা থেকে অনেক কম। তাই বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লট কাক্সিক্ষত ব্যবহারে ভরে যাচ্ছে না। সম্প্রতি মেট্রোরেলের অসমাপ্ত ভৌতিক অবকাঠামো নির্মাণের কাজে গতি ফিরে আসছে। তবে তার সঙ্গে সংযোগ সড়কগুলো অব্যবহারযোগ্য, তবে আশা জাগানিয়া আরো কিছু ঘটনা ঘটছে। আশপাশে ব্যক্তিক জমিতে আবাসন নির্মাণে গতি এসেছে, অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। উত্তরার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চড়া দাম থাকলেও বাড়ি ভাড়া কম। ১৮ নম্বরে রাজউক বিক্রীত আবাসনে থাকার মতো লোক এই সেদিনও পাওয়া ছিল দুষ্কর। বাজার ব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে আবাসনগুলো বলতে গেলে পরিত্যক্ত ছিল। তবে শিগগিরই যদি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ রাস্তাঘাটগুলো ঠিক মতো মেরামত করে, পানির সরবরাহ নিশ্চিত করে, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করে, জল প্রবাহের ড্রেনগুলো সমাপ্ত করে তাহলে রাতারাতি বহু আবাসনস্থল গড়ে উঠবে, প্রাতিষ্ঠানিক প্লটগুলো পূর্ণতা পাবে। যার ফলে এই চারটি সেক্টরে কয়েক লাখ লোকের ঠিকানা স্থির হয়ে যাবে। উত্তরার অন্য সেক্টরগুলো অতি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। পুরনো এলাকার সঙ্গে সম্প্রসারিত এলাকা মিলিয়ে বাসিন্দাদের বিশালাংশ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত হওয়ারই কথা। অর্থাৎ এরাই হবে মেট্রোরেলের সংগতিময় গ্রাহক। মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হলে ঢাকার সর্বত্রই রাস্তাঘাটের দুঃসহনীয় যানজট ও যানবাহনের চাপের কারণে উচ্চ-আয়ের মানুষও মেট্রোরেল ব্যবহার করবে। প্রাপ্ত সুবিধাদির কারণে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বরের আগেই মেট্রোরেল অন্তত আগারগাঁও পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে। তাতে বাণিজ্যিক সফলতা তেমন হবে না, তবে প্রযুক্তির সঙ্গে স্থানিক সংস্কৃতির সংঘাতগুলো চিহ্নিতকরণ ও দূরীকরণ কাজটা সহজ হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন অতি মূল্যবান মেট্রোরেল কার্যক্রমের বাধা হবে আমাদের কতিপয় পশ্চাদমুখী সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ। বিস্তারিত না বলেই শুধু ইঙ্গিতেই বোঝাচ্ছি। এসব আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও নব-আচরণ আত্মীয়করণের প্রারম্ভিক প্রয়াসটা আগেই শুরু করা বাঞ্ছনীয়। আমার ধারণা, ১৭ মার্চ অর্থাৎ জাতির মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন থেকেই মেট্রোরেল সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় আট মাস সময়ে আমরা মেট্রোরেল ব্যবহার অনুকূল কিছু অভ্যাস ও আচার আত্মস্থ করে পরবর্তী বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে সুষ্ঠু ও মসৃণ করতে সক্ষম হবো। অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা; ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App