×

মুক্তচিন্তা

ই-কমার্স প্রতারণার ফাঁদ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৫১ এএম

ই-কমার্স প্রতারণার ফাঁদ

বিশ্বব্যাপী অনলাইন ব্যবসা দিনে দিনে সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃত হচ্ছে এবং ব্যাপকতা লাভ করছে। সময়ের চাহিদা পূরণ করে ই-কমার্স এখন প্রচলিত ব্যবসার জায়গা দখল করে নিচ্ছে। পোশাক, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক সামগ্রী থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাবারসহ কী নেই যা এই ব্যবসার মধ্যে সংযুক্ত হয়নি। ব্যস্ত জীবনকে ঝামেলামুক্ত ও সহজ রাখতে যত যা কিছুর প্রয়োজন তার সবকিছুই এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। মাছ, মাংস, তরিতরকারি সবকিছু পাওয়া যায় শুধু তাই নয়, তা রান্নার উপযোগী করে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আমাদের যারা চাকরি করেন বা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন তাদের জন্য এসব খুব সহায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সময়ের অভাবে যারা ছোট মাছ বা কচুরলতি খাওয়া ভুলে যেতে বসেছেন তাদের জন্য সেগুলো কেটে পরিষ্কার করে সরবরাহ করার ব্যবস্থাও আছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও জীবনযাপনের খুঁটিনাটি পণ্য বিক্রির মাধ্যম হিসেবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর দারুণ সম্প্রসারণ ঘটছে। এরই পাশাপাশি আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে পুরো ব্যবস্থাটাই আস্থার সংকটের মধ্যে পড়ে আছে। যে কোনো ব্যবসায় সাধারণ মানুষ বা ভোক্তার আস্থাই প্রধান। মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হলে পুরো ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ই-কমার্সও এর বাইরে নয়। সম্প্রতি সময়ে ই-ভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে যে আঘাত করেছে তাতে কোনো বিবেচনায় এদের কার্যক্রমকে ব্যবসার আওতায় আনা যায় কিনা সন্দেহ। বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা যেখানে কে, কত দ্রুত ভোক্তার হাতে সততা ও আস্থার সঙ্গে পণ্য পৌঁছে দেয়ার প্রতিযোগিতা করে থাকে সেখানে বাংলাদেশে পণ্য হাতে পেতে বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়। ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা দ্বিতীয় জন টাকা দিলে তবে প্রথম জনের পণ্য সরবরাহ করে থাকে। মাছের তেলে মাছ বাজার মতো ব্যাপার। তাই অপেক্ষার পালা শেষ হয় না, মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পণ্য পাওয়া যায় না। ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলায় ‘হুন্ডি কাজল’ এক সময় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেশি লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় সাধারণ মানুষ নিজেদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে কাজল ও তার নিয়োজিত এজেন্টের হাতে তুলে দিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে কোটি কোটি টাকা জমা হলেও গ্রাহকদের লভ্যাংশ তো দূরের কথা, আসল টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে প্রথমে কয়েক দিন মাঠ সরগরম থাকার পর সব ঠাণ্ডা। হুন্ডি কাজলের সেই প্রাথমিক ব্যবসা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে ফিরে ফিরে পর্যায়ক্রমে আসছে এবং প্রতিবারই সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে দলে দলে। জাতীয়ভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণাই শুধু নয়, স্থানীয়ভাবেও কোটি কোটি টাকার ফাঁদে সাধারণ মানুষ পা দিয়েছে। প্রতারকরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলেও সাধারণ মানুষ যে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেছে তার নমুনা কোনোবারই দেখতে পাওয়া যায় না। দেশের এমএলএম কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকার ফাঁদে পা দেয়া সাধারণ মানুষকে দেখে ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হয়েছেন, অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শেয়ারবাজারের ফাঁদে পড়া মানুষকে দেখে ভরসা পেয়েছেন। ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা জানেন, বড় অঙ্কের ক্যাশ ব্যাক কিংবা ডবল ভাউচার এমন হাজারো বিচিত্র ও লোভনীয় অফার দিলে সাধারণ মানুষ দলে দলে ভিড় করবে। ৫০ হাজার টাকার পণ্য ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যাবে- এই অসম্ভব বিষয়কে বিশ্বাস করে মানুষ তার প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করছে। পরিণাম যা হওয়ার তাই শেষ পর্যন্ত হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যেই সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার শুরু হয়ে যায়। সরকার ২-৪ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রেখে বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও অর্থের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আবার ২-৪ জন বিদেশে পালিয়ে গিয়ে রাজকীয় জীবনযাপন করছেন। ফাঁদে পড়া মানুষের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখরিত হলেও কারো কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। বরং নতুন করে মানুষকে নতুনভাবে ফাঁদে ফেলার উদ্যোগ চলমান দেখা যাচ্ছে। দেশে ই-কমার্স কোম্পানির পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতারণার দায় কি শুধু সাধারণ মানুষের ঘাড়েই থেকে যাবে? গ্রাহকদের যে হাজার হাজার অভিযোগ তা দেখার কোনো কর্তৃপক্ষ কি দেশে নেই? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, র‌্যাব, সিআইডি, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, শুল্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থা এবং সবার উপরে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অথচ প্রতারণা যখন পর্যন্ত না মাথার উপরে উঠে যায় তার আগে তা কারো নজর পড়ে না। নিজ নিজ জনবল সংকটের কথা বলে অপেক্ষায় থাকে। হাহাকার চরমে উঠলে নড়াচড়া শুরু করে। অর্থমন্ত্রী যেমন ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন তিনি শেয়ারবাজার দেখেন না। তেমনভাবে বাণিজ্যমন্ত্রী যদি বলে দেন যে তিনি ই-কমার্স ব্যবসা দেখেন না। তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের হা-হুতাশ কমে যাবে। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যা ঘটছে তা তাদের ভবিতব্য। সরকারি কর্মচারীরা সরল বিশ্বাসের মধ্যে বসবাস করে সমন্বয়হীনভাবেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করুক। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ঘরে বসে পণ্য কেনার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আবার জনপ্রিয় এ ব্যবসাটা প্রতারণার ফলে আস্থাও হারাচ্ছে। দেশি প্রতিষ্ঠানের এ অবস্থায় বিদেশি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের আগমনও ঘটেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন ব্যবসা করে তা জানা ও বোঝা যাবে। তবে আমাদের বিদেশ প্রীতির কারণ দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো যে গভীর সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনই সতর্ক না হলে, প্রতারণার ফাঁদ বন্ধ না করলে, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন না করলে ব্যবসার পুরো জায়গাটাই বিদেশিদের দখলে চলে যাবে। যা দেশি উদ্যোক্তাদের জন্য সুখকর হবে না। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র কঠিন হয়ে পড়বে। এখানে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। অনলাইন পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা বন্ধের উদ্যোগ ও নজরদারি প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে রাখতে হবে। অভিযোগের পাহাড় তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেশ ও জাতি চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ লোভী না বোকা তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি। আবার এত বড় কথাটা বলতেও সাহস পাইনি। তারপর আবার চারদিকে তাকিয়ে কী বলতে হবে তাও বুঝে উঠতে পারিনি। সাধারণ মানুষ একটার পর একটা প্রতারণার শিকার হচ্ছে কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিতে রাজি না। প্রতারিত হওয়ার পর কয়েক দিন চিৎকার-চেঁচামেচি করে তারপর আবার নতুন এক প্রতারকের ছাতার তলায় সমবেত হয়ে পড়ে। বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনে নিজেদের হারিয়ে ফেলতে তারা সময় নেয় না। সম্ভব-অসম্ভব বিচার করার বোধটা হারিয়ে ফেলে। ই-অরেঞ্জের ‘ডবল ভাউচার অফারে একজন এক লাখ টাকা দিলে দুই লাখ টাকার ভাউচার পাওয়া যাবে, যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য কিনতে পারবে’- এমন অদ্ভুত আহ্বানে সাড়া দিলে না ঠকে উপায় আছে? ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে কী ভেবে এসব অফার দিয়ে থাকে তা না বুঝলেও এটা খুব ভালো করেই জানি আমরা শ্রমবিমুখ। পরের শ্রমে নিজেদের ভাগ্য গড়তে বিশ্বাসী। নিজেদের শ্রমে নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজ আমরা পছন্দ করি না। কালি মাখা হাতের চেয়ে আমরা দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর মানুষকেই বেশি পছন্দ করি। নিজেরা শিল্প কারখানায় উৎপাদন করার চেয়ে ট্রেডিং ব্যবসা বেশি পছন্দ করি। আমাদের সমাজটাও এখন এ রকমই। এই সমাজে বাস করে এক টাকার পণ্য ৫০ পয়সায় কেনার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করতে চাই না কেউই। আর তাই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সব হারাতে সময় লাগে না। এ অবস্থার উন্নতিতে নিজেদের বিচার-বিবেচনার প্রতি আস্থা রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। কিছু মানুষের বিলাসী জীবন তৈরি করার জন্য অসম্ভব অফার গ্রহণের মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে গেলে কীভাবে চলবে। সরকার সব করে দেবে বলে বসে থাকার আশার দিন শেষ। নিজের দায়িত্ব পালন করে তারপর সরকারের দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে একটার পর একটা প্রতারণার ফাঁদ পাতা চলতেই থাকবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা। সত্য-মিথ্যা বলতে পারব না। তবে খুব মজা পেয়েছিলাম তাই তা জানিয়ে আজকের লেখা শেষ করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। এক ভদ্রলোক মোটরসাইকেলের পেছনে একটা ঢাউস সাইজের ব্যাগ নিয়ে যেতে যেতে ফাঁকা জায়গা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে খাওয়া শুরু করে। কিছুটা খাওয়ার পর সেই প্যাকেট রেখে অন্য আর একটা প্যাকেট বের করে খায়। এভাবে বেশ কয়েক প্যাকেট থেকে খাওয়ার পর লোকটি আবার চলতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে বুঝতে না পারলেও শেষে অনুমান করি ভদ্রলোক কোনোখানে খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পালনকালে কয়েকটা প্যাকেট থেকে অল্প অল্প খেয়ে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করেছে। অনলাইন খাবার যদি এমন হয় তবে পণ্য সরবরাহ এমন হবে না কেন?

এম আর খায়রুল উমাম : কলাম লেখক, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App