×

জাতীয়

মাদকের ঢলে নিত্যনতুন চমক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৫২ এএম

মাদকের ঢলে নিত্যনতুন চমক

প্রতীকী ছবি

→  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে ডার্কওয়েভে চলে বিকিকিনি

কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না মাদকের ঢল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন করে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন নতুন নামের ভয়াবহ মাদকের আবির্ভাব ও বিস্তার। আবার মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে ক্রসফায়ারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। এর বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সরকারের হুঁশিয়ারি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেও ডার্কওয়েভে বিক্রি হচ্ছে নতুন ধরনের সব মাদক। দেশে এতদিন মূলত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার থেকে মাদক এলেও এখন পশ্চিমা বিশ্ব থেকেও আসছে মাদকের চালান। স্ক্যানার না থাকায় একাধিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তা সারাদেশে। এমনকি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দরে বসানো যাচ্ছে না স্ক্যানার মেশিন। কৌশলী কারবারিরা নিজেদের কাছে মাদক না রেখে নানা বয়সি শিক্ষার্থী ও তরুণদের ব্যবহার করে বাজার দখল করায় মূলহোতারা বরাবরই অধরা থাকছে। আটককৃতদের দেয়া তথ্যে অনেক ঘটনায় মূলহোতা ধরা পড়লেও তাদের কাছে মাদক না পাওয়ায় আইনি মারপ্যাঁচে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ মতে, মাদকসেবীরা তাদের স্বাদের পরিবর্তন চায়। ফলে তারা নতুন মাদক চায়। তেমনি ব্যবসায়ীরাও মূল উপাদান ঠিক রেখে নতুন নামে এবং স্টাইলে মাদক বাজারে ছাড়ে। আর করোনার কারণে ঘরে থাকায় অনলাইনে মাদকসেবীরা এসব নতুন নতুন মাদকের খোঁজ বের করে। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক গ্রহণের ফলে আসক্তদের দেহে এসবের প্রতিক্রিয়া কমে আসে। তারা উদ্দীপনার জন্য নতুন কিছু খুঁজতে থাকে। ব্যক্তিজীবনে হতাশা ও ব্যর্থতা ঢাকতেও শক্তিশালী মাদক খোঁজে তারা। মাদক কারবারিরা তখন চাহিদা বুঝে নতুন মাদক সরবরাহ করে।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, মাদক আমাদের দেশে তৈরি হয় না। ভারত বা মিয়ানমার থেকে আসে। মাদকের স্বর্গরাজ্য হলো মিয়ানমার। আমাদের টেকনাফের যত উপরে যাবেন- সেটা খুবই দুর্গম এলাকা। ওই এলাকা দিয়ে হেঁটে সীমান্তে যেতে হলে দুই থেকে তিনদিন লাগবে। কারণ কখনো পাহাড়ের উপরে উঠবেন বা নিচে নামবেন, কখনো পানির উপরে যেতে হবে বা দুর্গম বনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সে জায়গায় আমরা বর্ডার রুট করছি। এটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বছর দুয়েকের মধ্যে এটা শেষ হয়ে যাবে। বর্ডার রুট হয়ে গেলে আমাদের সীমান্ত রক্ষীরা সেখানে গিয়ে পাহারা দেবে। রুটটা চালু থাকলে এ ধরনের মাদক থেকে অনেকাংশেই মুক্তি পাব। শতভাগ হবে এটা আশা করি না, কিন্তু অনেকখানিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, আগে ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবার ব্যবহার বেশি হলেও ইয়াবার সঙ্গে নতুন নতুন মাদকের ব্যবহার শুরু হয়েছে। নতুন ধরনের মাদকের বড় বাজার হচ্ছে অনলাইনে। বাংলাদেশেও এই ধরনের মাদকের অনলাইন গ্রুপ আছে যোগাযোগ ও কেনা বেচার জন্য। তবে বাংলাদেশে এই মাদক ঢোকে কুরিয়ার সার্ভিস বা আকাশ পথে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা শুরু হলে তা আরো ছড়িয়ে পড়বে। তিনি জানান, এই নতুন ধরনের মাদকের দাম অনেক বেশি হওয়ায় এখনো এটা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তার সন্তান যিনি ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন তিনি ঢাকায় এসে আইস মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) সহাকারী পরিচালক মেহেদি হাসান জানান, ২০০৯ সালে একবার আইস মাদকসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়। আর এলএসডি মাদক প্রথম ২০১৯ সালে আমরা উদ্ধার করি। এরপর আরো অনেক পাওয়া গেছে। তিনি জানান, আইস এখন মিয়ানমার থেকেও আসা শুরু করেছে। যারা ইয়াবার কারবার করে তারাই আবার আইস কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আর এক গ্রাম আইস এখানে ১০-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ফলে এটা উচ্চবিত্তদের সন্তানরাই বেশি সেবন করছে। মাদক কারবারিরা এখন নতুন রুট ও কৌশল কাজে লাগাচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে নতুন মাদক খাত, ম্যাজিক মাশরুম, ডিএমডি, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফেটামিন, ডিওবি, অক্সি মরফিন ও এস্কাফ সিরাপ। এর প্রতিটিই বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যারা এসব মাদক নিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে তারা সবাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। এদের অনেকে বিদেশে পড়াশুনা করতে গিয়ে এ পথে পা বাড়িয়েছে। র‌্যাব গত জুলাই মাসে ঢাকার হাতিরঝিল থেকে ম্যাজিক মাশরুমসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে। গত জুন মাসে ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া থেকে এলএসডি মাদকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের হাফিজুর রহমান নামে একজন ছাত্রের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এই মাদকের সন্ধান পায় তারা।

মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য মতে, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা এখন ৭৫-৮০ লাখ। দুই বছর আগে যেটা ৭০ লাখের নিচে ছিল। মাদকাসক্তদের ৯০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তিন মাস পর পর মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা হালনাগাদ করে থাকে। সর্বশেষ তথ্য মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৫ হাজার মাদক কারবারি রয়েছে। তবে এই তালিকার সঙ্গে আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যায় বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। নেই উল্লেখযোগ্য অভিযান। এমনকি রাজধানীজুড়ে অবৈধ বার ও ক্লাবে মাদক বিকিকিনি চলছে প্রকাশ্যে। পুলিশ-র‌্যাব, বিজিবি- কোস্টগার্ড মাদকবিরোধী অভিযান চালালেও এর ঢল থামছে না। নিয়মিত হাত বদল হচ্ছে এর চালান।

একাধিক মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মালিক জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের মে মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে। ইয়াবার বিরুদ্ধে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও আনসারসহ সব বাহিনী জিরো টলারেন্স নীতিতে প্রায় দুই বছর টানা অভিযান চালায়। তাদের মতে, দেশের মাদকসেবীরা একই সময় বিভিন্ন মাদক গ্রহণ করে। যে ইয়াবা খায়, সে গাঁজাও খায়। বাংলাদেশে মাদকের বাজার বেশ বড়। এটা ধরে রাখতে একের পর এক কৌশল খাটাবেই কারবারিরা। ভৌগলিক কারণেও তাদের কাছে বাংলাদেশ প্রিয়। অভিযানের কারণে মাদক প্রবেশ হয়তো কমেছে, তবে মাদককারবারিরা বসে নেই। তারা নতুন মাদক নিয়ে ভিন্ন উপায়ে চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। এজন্য মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য মতে, চলতি বছরের (২০২১) জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সব সংস্থা মিলে (ডিএনসি, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড) ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯০৬ পিস ইয়াবা, ৩১ কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ৪১৫ কেজি হেরোইন, এক কেজি কোকেন, সাড়ে ৬৮ কেজি আফিম, ৭৫ হাজার ৯৭৯ কেজি গাঁজা, ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৩০ পিস ফেনসিডিল, ১০৬ লিটার ফেনসিডিল, ২ লাখ ৫ হাজার ৩১৪ বোতল বিদেশি মদ, ২ হাজার ৯৯৮ লিটার বিদেশি মদ, ৯৫ হাজার ৮৮১ ক্যান বিয়ার, ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৩৪ বোতল বিয়ার, ৮৯ হাজার ৭৪ পিস ইনজেকটিং ড্রাগ (অ্যাম্পুল) জব্দ করা হয়েছে। এই ১১ মাসে ৮৬ হাজার মামলা দায়েরের পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৬০৩ জনকে।

১১ মাসে শুধুমাত্র ডিএনসি জব্দ করেছে, ২৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪১ পিস ইয়াবা, ১১ কেজি হেরোইন, ৩ হাজার ৯০০ কেজি গাঁজা, ৬৩২টি গাঁজার গাছ, ২০ হাজার ২ বোতল ফেনসিডিল, ২ লিটার ফেনসিডিল, ১০৮ লিটার দেশি মদ, ৮ হাজার ৮৬০ লিটার চোলাই মদ, ৯৬ হাজার ২৮ লিটার জাওয়া, ২৪ হাজার ৩০২টি এ্যাম্পুল, ১ হাজার ৬৬৩ বোতল বিদেশি মদ, ৬২৭ ক্যান বিয়ার ও ১১ বোতল বিয়ার। এ সময়ে ৭৬ হাজার ৮২টি অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯ হাজার ৭৩৮ জনকে। মামলা দায়ের করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫১০টি।

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অভিযানে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮৯ হাজার কেজি গাঁজা, ৯২ কেজি হেরোইন, ৪৫ লাখ ৬ হাজার ৮৮২ পিস ইয়াবা, ৫৮ হাজার ৪৯৮ ক্যান বিয়ার, ৫২ হাজার ১৪৬ বোতল ফেনসিডিল, ২২ হাজার ২২১ টি অ্যাম্পুল, ৫৫৮ লিটার ও ৫ হাজার ৬০ বোতল বিদেশি মদ, ৯ হাজার ৮২৬ লিটার দেশি মদ, ১৪ হাজার ৮১৮ লিটার চোলাই মদ, ৯ হাজার ২৯০ পিস ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট, ২ কেজি ৬৯০ গ্রাম আইস, ১০ কেজি আফিম, ২৫ কৌটা ড্যান্ডি, ৩ হাজার ৩০০ পিস সিন্ডা ট্যাবলেট, ২২ কেজি সিসা, ৫ গ্রামের বেশি ও ৪০ পিস এলএসডি, ২ গ্রাম এফিটামিন, ১ গ্রাম ৩ মি.গ্রাম ডিএমডি, ২২৪ বোতল এমকেডিএল, ১৭৯ বোতল ইস্কার্ফ, ৬ হাজার ৫০০ পিস মরফিন ট্যাবলেট, ১২৬ মি.গ্রাম ডব ও ৩০ লিটার আফিয়াম জব্দ করা হয়েছে। এ সময়ে ১৪ হাজার ৬৮৮টি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ হাজার ৫৬৯ জনকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App