×

জাতীয়

মতবিরোধ মিটবে তো!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৯ এএম

মতবিরোধ মিটবে তো!

প্রতীকী ছবি

→ ওয়াশিংটনকে ঢাকার চিঠি, সম্পর্কের অবনতি হবে না : মোমেন

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। নতুন বছরের ছুটি শেষে আজকালের মধ্যেই যেন সেটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের দপ্তরে পৌঁছায় এমনভাবেই ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখা এ চিঠিতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার জন্য ব্লিঙ্কেনকে অনুরোধ জানিয়েছেন আব্দুল মোমেন। ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের আশাবাদ ব্যক্ত করার পাশাপাশি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন ও মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে র‌্যাবের ভূমিকার কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই এমন চিঠি পাঠানোর কথা নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যার সমাধান চায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত ছিল। তারা চায় সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বহাল থাকুক। এই নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা নিয়ে যে যাই বলুক, র‌্যাব চায় সরকার এই অচলাবস্থার একটা সমাধান খুঁজে বের করুক। একটি প্রশিক্ষণ চালুর ব্যাপারে র‌্যাব যুক্তরাষ্ট্রকে শিগগিরই চিঠি দেবে বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এমন চিঠি আরো আগেই দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্তের পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী যেভাবে কথা বলেছেন তাতে এই ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার মতবিরোধ আরো বেড়েছে। এর ফলে চিঠির জবাব সহসা নাও আসতে পারে। পাশাপাশি র‌্যাব ইস্যুতে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে চলমান মতবিরোধ নিরসনে এই চিঠির ভূমিকা কতটুকু কার্যকর হবে তা এখনো বলার সময় আসেনি। কারণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু চিঠি পাঠিয়েছেন, চিঠির সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাঠাননি। শুধু দুই লাইন চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে এটা ভাবা ঠিক হবে না। তবে এই চিঠির পর মার্কিন প্রশাসন হয়তো বাংলাদেশ সরকারের কাছে আরো তথ্য চাইতে পারে। অবশ্য এতকিছুর পরও ঢাকা মনে করে এই ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে না।

সিলেটে এক অনুষ্ঠান শেষে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে ফোনে যে বিষয়গুলো আলাপ হয়েছিল, সেগুলোই চিঠিতে লিখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন সংলাপে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত (নিষেধাজ্ঞা) অপ্রত্যাশিত। র‌্যাব প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। প্রতিষ্ঠানটির কারণে সন্ত্রাস, মাদক ও মানবপাচার কমেছে। তাই এই সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে তাজ্জব মনে হয়েছে। আব্দুল মোমেন আরো বলেন, এগুলো (যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত) তো হাসির খোরাক। এটা (র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা) ঠিক হয়নি। বিষয়টি যাচাইয়ের সুযোগ আছে। মানবাধিকারের বিষয়ে আমরা সোচ্চার। এ নিয়ে আমরা আপস করি না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে তারা বলেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ৬০০ লোক মিসিং হয়েছে, র‌্যাব এটা করেছে। কিন্তু আপনার দেশে প্রতিবছর লাখখানেক লোক মিসিং হয়। শখানেক লোক আপনাদের পুলিশই মেরে ফেলে। আপনারা এগুলোকে বলেন ইন দ্য লাইন অব ডিউটি। আর আমাদের দেশে পুলিশ এটা করলে বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এগুলো তো হাসির খোরাক। এই ইস্যুটি পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। আমরা এ কথাটাই চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছি। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর আগে গত

মাসে যখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো তখন তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের নীতিই হলো মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। এর উত্তরে আমি বলেছি, বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্যই স্বাধীন হয়েছে।

চিঠিতে যা বলা হয়েছে : র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও বাহিনীর বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেনকে চিঠি পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বিদায়ী বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর মোমেনের স্বাক্ষরসংবলিত ওই চিঠি ওয়াশিংটনে গেছে।

চিঠিতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদকসহ আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ দমনে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন মন্ত্রী। সেই সঙ্গে ‘দুঃসাহসিক এসব কাজে’ এলিট ফোর্স র‌্যাবসহ অন্য বাহিনীগুলোর অবদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ তুলে র‌্যাবের বর্তমান-সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বাইডেন প্রশাসন।

এটি বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নিষেধাজ্ঞা, যা সরকারকে বেশ চাপে ফেলেছে বলে মনে করছেন দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও কূটনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ তৈরি হয়েছে। যদিও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। মন্ত্রী মোমেন এও জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের ৩ মন্ত্রীকে আলাপ-আলোচনার যে দায়িত্ব দিয়েছেন তারা সেটি করছেন। তিনি বলেছিলেন, আলাপ-আলোচনা করেই তারা এর আনুষ্ঠানিক জবাব পাঠাবেন। এমনি হুট করে উত্তর দেয়া ঠিক হবে না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাজারো ঘটনা ঘটার পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, প্রতিবছর তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) পুলিশ হাজারখানেক লোক মেরে ফেলে, গুলি করে মারে। অর্থাৎ আইনবহির্ভূত হত্যা করে। আমাদের কালেভদ্রে এক-দুজন মারা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ছয় লাখ লোক নিখোঁজ হয়। মার্কিন প্রতিবেদনের দাবি, বাংলাদেশে ১০ বছরে ৬০০ লোক নিখোঁজ হয়েছে। কোথায় ছয় লাখ আর কোথায় ৬০০? আমেরিকায় যে এত লোকজন মারা যায়, এ জন্য তাদের সংবাদমাধ্যম খুব বেশি মাথা ঘামায় না। কারণ তারা মনে করে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাদের লাইন অব ডিউটিতে কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর দাবি করে মন্ত্রী বলেছিলেন, কিছু কিছু লোকের প্ররোচনায়, কিছু সংস্থা এবং এনজিওর মিথ্যা তথ্যে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করব। ‘আমেরিকার সব সিদ্ধান্ত সঠিক, এমন নয়’ মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেছিলেন, এর ভূরিভূরি উদাহরণ রয়েছে। তারপরও আমরা আলোচনা করব এবং আশা করি ওই দেশে পরিপক্ব লোকজন আছেন, সরকারে জ্ঞানী লোকজন আছেন এবং তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবেন।

সরকারের একটি সূত্রের দাবি, রাজনৈতিক বক্তব্য যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি চায় না ঢাকা। ওয়াশিংটনও এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। আর এ জন্য আলোচনার চেষ্টা চলছে। সেই বিবেচনায় পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র এবং আইনমন্ত্রীর মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশ সুচিন্তিত একটি জবাব পাঠিয়েছে, যা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বরাবর পাঠিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। বিশদ বর্ণনাসংবলিত ওই চিঠি পাঠানোর বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চিঠিটি আরো এক সপ্তাহ আগেই পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু হয়, কিন্তু নানা কারণে তা বিলম্ব হয়েছে। ওই সূত্রটি জানায়, চিঠিটি ই-মেইল মারফত ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টে চিঠিটি হস্তান্তর করার কথা রয়েছে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলামের।

যা বললেন বিশ্লেষকরা : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া চিঠিকে স্বাভাবিক কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। গতকাল তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, র‌্যাব ইস্যুতে যে মতবিরোধ আছে সেটি নিরসনের জন্যই ঢাকার পক্ষ থেকে এই চিঠি দেয়া হয়েছে। এখন এই চিঠিকে মার্কিন প্রশাসন কীভাবে দেখবে এটা তাদের বিষয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া চিঠির ফলাফল হয়ত শিগগিরই আসবে না। তবে এই চিঠির একটি গুরুত্ব আছে। এই চিঠির মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে একমত নয় তা বোঝানোর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখে একটি প্রতিক্রিয়াও দেয়া হলো। তিনি বলেন, চিঠির কারণে মার্কিন প্রশাসন থেকে অদূর ভবিষ্যতে একটি বার্তা আসতে পারে। তবে সেই বার্তাটিও বাংলাদেশের কর্মকাণ্ডের ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে বলে মনে করেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া চিঠিকে ‘রুটিন ওয়ার্ক’ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সাইফুদ্দীন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, এর বাইরে ঢাকার পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনো কিছু করার ছিল না। তবে মন্ত্রী যে চিঠি দিয়েছেন তার স্বপক্ষে তথ্য-উপাত্ত না দিলে কোনো লাভ হবে না। তার মতে, মার্কিন প্রশাসন র‌্যাব ইস্যুতে একদিনে সিদ্ধান্ত নেয়নি। কাজেই চিঠি পাওয়ার পরপরই যে তারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা কিংবা প্রত্যাহার করবে তা ভাবা ঠিক হবে না। বরং তারা আরো তথ্য চাইতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ওয়াশিংটন দূতাবাস বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কাজ করছে সেটিও দেখতে হবে। সেখানে কূটনৈতিক ঘাটতি দেখা দিলে কিছুটা সমস্যা হবে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App