×

মুক্তচিন্তা

নতুন বছর আবাহনে সদাচার প্রত্যাশা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২২, ০২:৫৩ এএম

বছর ঘুরে নতুন বছর আসে। বিদায়ী বছরের ‘সালতামামি’ আমরা যেমন তৈরি করি তেমনি নতুন বছরের জন্য আমরা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের জন্য শুভেচ্ছা জানাই; ক্যালেন্ডার-ডায়েরি প্রিয়জনকে উপহার দিই। ২০২১, যে বছরটি ফুরিয়ে যাচ্ছে, সে বছরটিও ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল; এ বছরও আমরা হারিয়েছি বেশ ক’জন দেশবরেণ্য ব্যক্তিকে; সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও ঘটে গেছে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ‘গতস্য শোচনা নাস্তি!’ বলে সেসব বিষয়ে কালক্ষেপণ না-ই বা করলাম; তাছাড়া ‘সালতামামি’ কলামে অধিকাংশ পত্রিকাই আমাদের সামনে নিয়ে আসবে; আমি বরং আগামীর কথা কিছু বলি, অভ্যাসবশত কিছু প্রত্যাশার কথা উচ্চারণ করি এবং তাও আবার শিল্প-সাহিত্যের গণ্ডিতে থেকে। প্রত্যাশার কথা যখনই উচ্চারণ করতে চাই, কেন জানি বুকের ভেতর ধ্বনিত হয় জীবনানন্দ দাশের সেই অমোঘ কবিতাটি, যে কবিতা সুযোগ পেলেই আমি উচ্চারণ করি; আমি উচ্চারণ করি নিজেকে সতর্ক করতে, উচ্চারণ করি বাস্তবতার মুখোমুখি হতে এবং উচ্চারণ করি নিজেকে সান্ত¡না দিতে; পরোক্ষে মনে করিয়ে দিতে কেন আমাদের প্রত্যাশাগুলো অঙ্কুরেই শুকিয়ে যায়; কেন আমাদের আকাক্সক্ষাগুলো বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে! উচ্চারণ করি নিজে সদাচারী হতে, সবার কাছে সদাচারী হওয়ার আহ্বান জানাতে। আজকের প্রত্যাশা উচ্চারণের আলোচনার শুরুতেই পুনর্বার জীবনানন্দ দাশের সে কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেই আলোচনার সূত্রপাত করব- অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। (অদ্ভুত আঁধার এক \ জীবনানন্দ দাশ) আত্মকেন্দ্রিকতা আজ এমন এক মায়াজালে বন্দি- আমরা যেন সামষ্টিক বিষয়গুলোকে আনুষ্ঠানিক আচারে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি! ‘সামষ্টিক চেতনায় তিনি মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন, আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই!’ কারো জন্য এমন অঙ্গীকার উচ্চারণের দিন কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? আমাদের পরিপার্শ্বে কি আজ সামষ্টিক চেতনার মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে? আজকের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা হচ্ছে, আপনি যদি সামষ্টিক চেতনায় বিশ্বাসী হন, যদি সত্য-ন্যায়-কল্যাণব্রতী হন, আপনাকে বারবার থমকে দাঁড়াতে হবে। বারবার নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে, ‘তুমি কার জন্য লড়ছো? কাকে সাথে নিয়ে লড়ছো? কে তোমার সহযোদ্ধা হবে ন্যায়ের পক্ষে- কল্যাণের পক্ষে? সত্যের বাতি কি আজো কোথাও জ্বলছে? ন্যায়ের পক্ষে কোথাও কি কেউ গলা সাধছে?’ এবং এত শত আত্মজিজ্ঞাসার পরও কি আপনি ন্যায়ের পক্ষে-কল্যাণের পক্ষে লড়বার সাহসটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন? যদি পারেন আপনাকে সেলুট জানাই। যখন আমাদের চারপাশে এত ছল-চাতুরী, এত মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনার এত বাড়াবাড়ি, তখন আমাদের বিভ্রান্ত হওয়াই সঙ্গত। তথ্যপ্রযুক্তির ডামাডোলের মধ্যে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত হবার সুযোগ আরো বেশি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রাতগুলো যেন বিভ্রান্তি তৈরির কারখানা। প্রতি রাতেই বিভিন্ন চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ আলোচকগণ সমসাময়িক নানা বিষয়ে চ্যানেলের ‘টিআরপি’ বৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন। বিষয় একটা পেলেই হলো, সেই বিষয়েই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সপক্ষের গুণকীর্তণে কসরত করে চলেন। লক্ষ করে দেখেছি, বন্ধুদের অনেকেই মিডিয়ার সেইসব ‘টক-শো’ দেখে অলস সময়ের জন্য উত্তেজনা কিনেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস ‘টক-শো’গুলো ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’! দীর্ঘ আলোচনার পর পরিশ্রান্ত মন নিয়ে হাতে কী পান?- ‘দড়ি’! ‘সারারাত সাপ মেরে সকালে পাই দড়ি’! অবস্থাটা এমনি। উপসংহারে অনুষ্ঠানের ‘মর্ডারেটর’ কোনো মীমাংসার বাণী শোনাতে পারেন না; তার মানে এ আলোচনা চলতেই থাকে; সেখানেও অপমৃত্যু ঘটে আমাদের প্রত্যাশার। আমাদের সাহিত্যে যখন নীতিকথা উচ্চারণের প্রবণতা ছিল, তখন দেখেছি গল্প-কবিতা-প্রবন্ধে কত শত নীতিকথা উচ্চারিত হতো, সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। আধুনিকতা, অত্যাধুনিকতা ইত্যাদি অভিধায় সাহিত্যের অগ্রগতি নিশ্চয়ই হচ্ছে, কিন্তু প্রযুক্তি আর আধুনিকতার নামে অজস্র দুর্বৃত্তায়নও ঢুকে পড়ছে শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে। পাঠে অনাগ্রহী তারুণ্য যেমন অনাচারের আশ্রয় নিচ্ছে এবং স্তাবকতায় মনোযোগী হয়ে উঠছে; অন্যদিকে প্রবীণরাও নিজেদের স্বার্থচিন্তায় তারুণ্যকে ঠেলে দিচ্ছে বিভ্রান্তির পথে। আমরা যারা সদাচারের কথা বলে গলা ভাঙছি, তারাই অসদাচারে নিজেদের নিয়োজিত রাখছি; বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে প্রতারণা করছি। আমি রাজনীতির মানুষ নই, এ কথা যতটা সত্যি, ততটাই সত্যি, পৃথিবীতে বাঁচতে চাইলে রাজনীতিশূন্য হবার সুযোগ নেই। কোথাও না কোথাও আপনাকে আশ্রয় নিতেই হবে। সেটা অবশ্য অপরাধ নয়, অপরাধ তখন যখন আপনি ‘দলকানা’ হয়ে পড়েন। দলের স্বার্থ চিন্তায় প্রায়শ সত্য উচ্চারণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। কে কতভাবে নিজের দলের সপক্ষে মানুষের সহানুভূতি পেতে পারেন; নিজেকে দলের জন্য অনিবার্য করে তুলতে পারেন, চলছে তার প্রতিযোগ। কতভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারেন; ইত্যাদি। এবং এভাবেই অযোগ্যরা আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছেন, প্রাজ্ঞের আসন দখল করে নিচ্ছে। তাদের আলোচনার ভাবখানা এমন, যেন দেশে এবার একটা ‘মহাবিপ্লব’ ঘটে যাবে। আমরা তো বটেই, এমনকি যারা আলোচনায় তর্কের ঝড় তুলছেন, প্রত্যেকেই জানেন- ‘সহস্র শূন্যের যোগে তুমি ক্ষীণকায় এক রুগ্ণ শূন্য পাবে জোয়ার পেরিয়ে গেলে স্ফীতজল ভাটায় গড়াবে।’ আমার কথাগুলো কিছুটা একপেশে মনে হতেই পারে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রাগ্রসর একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে এ প্রত্যাশা আমি রাজনীতিকদের কাছে করতেই পারি। সে ক্ষেত্রে আমার জিজ্ঞাসা, রাজনীতিকরা কি আমার মতো একজন সামান্য সংস্কৃতি কর্মীর প্রত্যাশা পূরণে ব্রতী হবেন? ‘সামষ্টিক চেতনার’ চর্চা এককভাবে কেউ করলেই চলবে না; সে চেতনায় আত্মনিবেদন করতে হবে প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মীকে; তখনই আমরা বলতে পারব- রাজনীতির সুবাতাস বইছে আমাদের পরিপার্শ্বে। এবারে প্রশ্ন হলো, আমি যে রাজনীতিকের কাছে সদাচার প্রত্যাশা করব, আমি নিজে আমার কাজে কতটা সদাচারী? নতুন বছরের প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এসব কথা কেন বলছি? সে কথার উত্তর দিয়েই আমার কথার ইতি টানব। আমি বিশ্বাস করি নতুন বছরকে আবাহন করতে গিয়ে আমি যেন ভুলে না যাই, আমি বাঙালি, আমার আছে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জনের গৌরব। এক নদী রক্তের বিনিময়ে আমি স্বাধীন করেছি দেশ। বঙ্গাব্দ বা খ্রিস্টাব্দ, যে বছরকেই আমি বরণ করি না কেন, অবশ্যই আমি যেন তাকে আমার নিজস্ব সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে বরণ করি। বাঙালির নববর্ষকে বরণ করতে রবীন্দ্রনাথ যে উচ্চারণ করেছেন- এসো হে বৈশাখ এসো এসো তাপসনিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক \ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি অশ্রæবাষ্প সুদূরে মিলাক \ মুছে যাক গøানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি, আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ। মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক \ রবীন্দ্রনাথের এই শাশ্বত গানটির দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, সহজেই দেখব এ গানে প্রত্যাশার সঙ্গে আছে অঙ্গীকার। নিজের ভেতরের অন্ধতাকে যদি আমরা দূর করতে না পারি, তাহলে শুদ্ধ হবার শক্তি কোথায় পাব। তাই বলি, কেবল কথায় নয়, কর্মে-আচরণে-প্রতিজ্ঞায় আমাদের সদাচারী হতে হবে। শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন সে আবশ্যিকতার বাইরে নয়। ১৯৭১-এ আমরা একজন সদাচারী নেতার স্পর্শে সদাচারী হয়ে উঠেছিলাম বলেই আমাদের পক্ষে অমন মহৎ বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। সদাচারী হতে পেরেছিলাম বলেই দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে পেরেছিলাম হাসি মুখে; আবার ১৯৭৫-এ সদাচার থেকে স্খলন হয়েছিল বলেই, নিজেদের মধ্যে দেখা দিল বিভেদ-হানাহানি। লোভের বশে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থেও প্রলোভনে আমাদের চরিত্রে যে অধোপাত, তা থেকে মুক্তি পেতে সদাচারী হবার বিকল্প দেখি না। একজন সৃজনকর্মী হিসেবে নতুন বছরকে বরণ করতে গিয়ে, প্রথমত আমি নিজের সাথে অঙ্গীকার করতে চাই সদাচারী হবার; বন্ধুদের গোটা সাহিত্য সমাজকে আহ্বান জানাই সদাচারী হবার এবং অতঃপর সমাজের অন্যসব পেশা ও গোত্রের মানুষের কাছে নিজেদের সৃজনশৈলী দিয়ে সদাচার প্রত্যাশা করি। জয় হোক বাংলার মেহনতি মানুষের! সার্থক হোক বাংলার লাখো মানুষের আত্মত্যাগের গৌরব! ২০২১-এর যত গøানি, যত বিষাদ, যত ভ্রান্তি, ২০২২-এ বিলোপ হোক; দেশপ্রেমের মহান ব্রতে দীক্ষিত হয়ে নতুন বছরে আমরা সদাচারী হবার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠি। ১৯৭১-এ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদাচারী হবার যে স্বপ্ন আমাদের চোখে এঁকে দিয়েছিলেন; সেই চেতনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হই নতুন বছর ২০২২-এ। জয় বাংলা। সূর্যের আলো নিয়ে বাঁচে চাঁদ তবু সে একক মায়া নিজের ভেতর রেখেছে লুকিয়ে অনুপম রূপকায়া; স্বপ্নের দিনে আজ অকপট সানুনয় বলে যাই চাঁদের উপমা চন্দ্র কেবল শশীর উপমা নাই; আজ শুধু তাই চাঁদ-বন্দনা চাঁদের আরতি করি সূর্যটা যেন চাঁদের প্রেমিক মগ্ন প্রণয় ঘড়ি; সূর্যটা যদি অনুনয় করে চন্দ্রকে ছুঁয়ে থাকে নিশ্চয় চাঁদ মৃত্তিকা হয়ে সূর্যকে বুকে ডাকে। ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক; সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App