×

জাতীয়

ধর্ষণ ও বাল্যবিয়ের নতুন রেকর্ড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৪৬ এএম

ধর্ষণ ও বাল্যবিয়ের নতুন রেকর্ড

প্রতীকী ছবি

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রতি বছরই বেড়ে চলছে। আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ার হিসাবটা যেন ঠিকই থাকে। ২০২০ সালে করোনার অতিমারিতেও পিছু ছাড়েনি নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা। বরং এ ধরনের ঘটনা কয়েক গুণ বেড়েছে। পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার পাশাপাশি পরিস্থিতির যে অবনতি হবে এমন আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। সেই আশঙ্কাই সত্য হলো। ২০২১ সাল জুড়েই সারাদেশে বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। বেড়েছে নারী, কিশোরী ও শিশু নির্যাতন, যৌন সহিংসতা, হত্যার সংখ্যাও। পথে-ঘাটে, গণপরিবহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পরিবারে এমন কি বেড়াতে গিয়েও নারী ও কন্যা শিশুরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলছাত্রীকে (১৭) ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার আসামি ১৮ বছর বয়সি দিহান। কিশোর বয়সিদের এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে বছরের শুরুতেই বেশ আলোচনা হয়। এরপর থেকে রোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনা একের পর ঘটতেই থাকে। ২১ নভেম্বর হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে বাসের চালকের সহকারী যৌন নিপীড়ন করলে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের কারণে সব বিভাগীয় শহরে শিক্ষার্থীদের জন্য বাসভাড়া অর্ধেক করার সিদ্ধান্ত হয়।

১৯ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে যাত্রীবাহী একটি বাসে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক ও দুই সহকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে কক্সবাজারে স্বামী, শিশুসন্তানসহ বেড়াতে গিয়ে এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। একই সময়ে বান্দরবানে ছেলেমেয়েকে বেঁধে রেখে প্রবাসীর ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

পারিবারিক নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, স্বামীর পরকীয়ার জেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। ২৭ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের এক তরুণীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে দায়ী করে মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় জামিনে আছেন আনভীর।

১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পরিবাগের দুটি ৯তলা ভবনের মাঝ থেকে উদ্ধার করা হয় ইভানা লায়লা চৌধুরী (৩২) নামে এক নারীর মরদেহ। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইলমা চৌধুরী এবং ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে বেসরকারি সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মাহমুদা খানমের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মহামারিতে পারিবারিক নির্যাতন ও মৃত্যু দুটোই বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫৫৪ ও ৪৫৭। এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬০৮টি। এর মধ্যে ৩৫৫টি হত্যা ৩৫৫ এবং আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৩২টি। আর সংগঠনের ১১ মাসের (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর) তথ্য বলছে, ধর্ষণের ঘটনা ১ হাজার ২৪৭, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৪৬ জন। এছাড়া গৃহকর্মী নির্যাতন ৪১, যৌন হয়রানি ১৯৬ এবং এসিড সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২২টি। আর ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৩ জনকে।

১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি আয়োজিত ‘বাংলাদেশে যৌন হয়রানি : বর্তমান প্রেক্ষাপট ও প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, দেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ নারী ক্রমাগত রাস্তা, যানবাহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি বাড়িতেও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সহিংসতার আরেক ধরন বাল্যবিয়েও ছিল এ বছরের আলোচনায়। করোনা অতিমারির কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। বাল্যবিয়ে নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও বেসরকারি সংগঠনগুলো বলছে, এ সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, বিভিন্ন পত্রিকায় এ বছর বাল্যবিয়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে ২৮৪টি। এর মধ্যে ১৮৫টি বাল্যবিয়ের খবর প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বরে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৪টি। শুধু ঘটনা বেড়েছে এমন নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, ঢাকায় গত বছরের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাও বেড়েছে।

২০২১ সালে কিছু বিচারিক রায়ও ছিল আলোচনায়। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলার রায় হয় ১১ নভেম্বর। এই ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ৫ আসামিকে খালাস দেন বিচারক। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এই মামলার পর্যবেক্ষণে ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের অভিযোগে কোনো মামলা যেন পুলিশ না নেয় সেই নির্দেশনা দেন। বিচারকের এমন পর্যবেক্ষণে ক্ষোভে উত্তাল হয় পুরো দেশ। ওই অভিযোগে তাকে বিচারকাজ থেকে প্রত্যাহার করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। যদিও লিখিত রায়ে বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ বাদ দেন তিনি। এরপরই আলোচনায় আসে তিন বছরের পুরনো এক ধর্ষণ মামলায় আসামির জামিনকাণ্ড।

২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে পরবর্তী সময়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই মামলায় ১৩ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। এর পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক জয়নাল আবেদীন এ রায় ঘোষণা করেন।

এছাড়া চিত্রনায়িকা পরীমনিকে বারবার রিমান্ডের বিষয়টিও গত বছর আলোচনায় ছিল। ৪ আগস্ট রাতে প্রায় চার ঘণ্টার অভিযান শেষে বনানীর বাসা থেকে পরীমনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিন দফায় মোট সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে। ৫ আগস্ট প্রথম দফায় ৪ দিন, ১০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ২ দিন এবং ১৯ আগস্ট তৃতীয় দফায় আরো ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয় তার। পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনায় দুই বিচারক দেবব্রত বিশ্বাস ও আতিকুল ইসলামকে গত ২ সেপ্টেম্বর তলব করেন হাইকোর্ট। গত ৩১ অক্টোবর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চে তারা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সঠিক যৌন শিক্ষা না থাকায় একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত এসব ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া এই অবস্থার থেকে পরিত্রাণ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App