×

মুক্তচিন্তা

আত্মতুষ্টির সঙ্গে প্রয়োজন আত্মমূল্যায়নেরও

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৪৯ এএম

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রুক্ষ, বৈষম্যমূলক ও নব্য ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বেড়াজাল ভেঙে বাঙালি জাতি বৈষম্যহীন ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য শামিল হয়েছিল একটি অসম জনযুদ্ধে। বেলুচি-পাঠান আধিপত্য বিশিষ্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পোড়ামাটির নীতির ফলস্বরূপ প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। তাদের নীলনকশায় এটা স্পষ্ট ছিল যে, যদি একান্ত এদেশ ছাড়তেই হয় তবে ছাড়ার আগে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে যাবে। যেন আগামী ৫০ বছরেও বাঙালি দাঁড়াতে না পারে। ভূ-অবস্থানগত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আধার, স্বল্প আয়তন বিশিষ্ট ভূখণ্ডে পাহাড়সম জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না- এমন ভবিষ্যদ্বাণী অনেক পুরোধা অর্থনীতিবিদ করেছিলেন। এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক তথাকথিত বরেণ্য ব্যক্তি তো বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি ও উন্নয়ন- যোগ্যতার পরীক্ষাগার’ বলে আখ্যায়িত করে সদ্য স্বাধীন দেশের ভঙ্গুর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিয়েছিল দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। সেই সময় এটা যারা বলতেন তারা উক্ত বিশেষণের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে বহুসংখ্যক বাধা আর বিপত্তির কথা তুলে ধরতেন যেমন স্বল্প শিল্পায়ন, দুর্বল ভঙ্গুর অবকাঠামো, নিম্ন শিক্ষার হার, অনুন্নত যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা, অপ্রতুল ও সীমাবদ্ধ সম্পদ ও চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও হার না মানা, কর্মঠ, আত্মবিশ্বাসী বাঙালির ইস্পাত সদৃশ বিশ্বাস ছিল সব কটূক্তি কাটিয়ে একদিন বিশ্ব মানচিত্রে সগৌরবে সমৃদ্ধ স্বনির্ভর জাতি হিসেবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। উন্নয়নের সামগ্রিক চিত্ররূপ তুলনা করলে এটা প্রকৃষ্ট রূপে প্রতীয়মান যে, মাথাপিছু আয়, মাতৃমৃত্যু হার, উন্নত চিকিৎসাসেবা, দারিদ্র্যহার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য নিরসন, সার্বজনীন শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা, জলবায়ু উদ্ভূত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ নব্য উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলা করে আমরা এখন একটি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। কিন্তু বলতে রুক্ষ ও তিক্ত শোনালেও বাস্তবতা এটাই যে, এতসব দৃশ্যমান উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জন্ম নেয়া উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা এখনো অনেকটা পিছিয়ে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকল ভেঙে সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্মত দেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ একটি অসম জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে এখন আত্মমূল্যায়নের উপযুক্ত সময় যে, অর্ধশত বছর পরে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন রিপোর্ট এই বার্তাই দিচ্ছে- উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য হ্রাসসহ অর্থনীতির অনেক মানদণ্ডে উন্নতি করলেও আয়বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। বিশেষত করোনার প্রভাবে সৃষ্ট নতুন দারিদ্র্যে এতদিনের দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্য বেসামাল। উদ্ভূত নতুন দরিদ্র শ্রেণির জন্য সুনির্দিষ্ট প্লান-পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়। এদিকে করোনার অভিঘাতে চাকরি হারিয়ে বহুসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ বেকার। জীবন-জীবিকার দ্ব›েদ্ব মুমূর্ষু এ-সব মানুষ চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছে। মানুষের এরূপ আর্থিক দৈন্যদশা সামাজিক অস্থিরতাকে প্রকটভাবে উসকে দিচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির। বিশ্বের যে কয়টি দেশ রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি স্বতন্ত্র পার্থক্য হলো, ১৯৭১ সালের জনযুদ্ধে শিক্ষিত, প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির পাশাপাশি কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমোর, তাঁতী-জেলেসহ খেটে-খাওয়া মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া ছিল, যা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য নিদর্শনস্বরূপ। এ-সব গা-গতর বিক্রির বিনিময়ে রুটি-রুজির বন্দোবস্তকারী মানুষগুলোর একটাই স্বপ্ন ছিল- তাদের আর বৈষম্যমূলক সমাজে শোষণ-নিপীড়নের শিকার হতে হবে না। মানবাধিকার নিশ্চিতের সঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মিত হবে। অকপটে বলে যায় বিগত ৫০ বছরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আমাদের অর্জন অনেক উন্নত দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সুশাসন ও মানবাধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা পূর্ণ, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন মুক্ত একটি সাম্য-মানবিক মর্যাদা-সামাজিক ন্যায়বিচার পুষ্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আমাদের অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবেই আমরা পাব আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। আর এজন্য অর্জন নিয়ে যেমন প্রয়োজন আছে আত্মতুষ্টির, ঠিক তেমনি প্রয়োজন আছে আত্মমূল্যায়নেরও।

সিরাজুল ইসলাম সোহাগ : লেখক ও গবেষক, ঢাকা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App