×

মুক্তচিন্তা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাল্লার ভার শেখ হাসিনারই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:২৫ এএম

বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর। বেশ পরিণত বয়স বিজয়ের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে সদ্য প্রসূত বিজয় আজ পরিণত বয়সে পৌঁছেছে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনেকটা পথ এগিয়েছে। সত্তর দশকের শেষপ্রান্তে বিদেশ পাড়ি দেয়া একজন প্রবাসী বাঙালি দীর্ঘদিন পর দেশে এসে বললেন, দেশের অবকাঠামোগত এত উন্নয়ন যে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চেহারা একটুও কোথাও যেন আর নেই। কী অসাধারণ পরিবর্তন, উন্নয়ন! সত্যিই তাই অবকাঠামোগতভাবে দেশ বেশ এগিয়েছে। রাতের ঢাকা শহর আকাশ থেকে দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে উন্নত একটি দেশের ছবি দেখছে যেন। বিদ্যুতের পর্যাপ্ত ব্যবহার, আলোর উপস্থিতি আলোকিত করে রাখে সব। ফোয়ারা-ঝর্ণা, রাস্তাঘাট, নির্মাণাধীন উড়াল সেতু, মেট্রোরেল, অকাশচুম্বী অভিজাত হাসপাতাল, আবাসন, প্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিক রিসোর্র্ট-হোটেল-রেস্তোরাঁ, অতিধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি, নাগরিক সুবিধাদি ভোগ, স্থানীয় প্রশাসনকে জনগণমুখী করে রাখার চেষ্টা ইত্যাদির নমুনা উন্নয়নের কথাই বলে। মন খারাপ করা, হতাশ হওয়ার মতো ব্যতিক্রম ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকলেও বিষয়টি সত্য। বিতর্ক করে লাভ নেই এই বিষয়ে, অস্বীকারও নয়। চোখের সামনে যা দৃশ্যমান তা অস্বীকার করা নিছক বোকামি, ক্ষীণবুদ্ধির পরিচয়। চেতনা ও সত্য বলার সংকীর্ণতাও বটে। রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দল যতই উন্নয়ন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করুক না কেন, এটা নেহায়েতই তাদের রাজনৈতিক বিরোধিতা। জনগণ বুঝে তা। আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ও নাগরিক সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, সহজ করে দিয়েছে এবং এতে সরকারপ্রধানের কঠোর নির্দেশনা আছে এটা মানতেই হবে। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সড়ক কাঠামো চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না যে, এসব অঞ্চলের মানুষ জীবন-জীবিকাকে কতটা সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন, অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি, সেখানকার বাসিন্দারা আত্মনির্ভরশীল হতে শিখেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের বেশ স্পষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে। নিজেদের অধিকার বুঝে, অন্যকে বোঝায়। বলতেই হয় যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার স্বপ্ন, চেতনা দেশকে, দেশের মানুষকে উন্নয়নের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন। তার শাসন, পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা দেশকে যতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে বিএনপি সরকার তার ক্ষমতামলে তা পারেনি। দেশে বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে শক্তিশালী হলেও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে তেমন শক্তি ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেনি। নেতার মুক্তির আন্দোলন ছাড়া জনকল্যাণের দাবিতে তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা, তৎপরতা খুব একটা দেখা যায়নি। পরিচয় দিতে কিংবা দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। যদিও বিএনপির ভেতর অন্তর্কলহ রয়েছে, দ্ব›দ্ব রয়েছে। আর তাই নেত্রীর সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবির আন্দোলনেও নেতাকর্মীদের ভেতর মারামারি হতে দেখা যায়। অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনের ভেতরও কলহ, বিবাদ, সংঘর্ষ দেখা যায়। এটা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। আর সে কারণে ব্যক্তিস্বার্থ প্রকট, দেশের স্বার্থ গৌণ রাজনৈতিক চর্চায়। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তি-যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নারী ও পুরুষের ক্ষমতায়ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উল্লেখ করবার মতো যতটা খালেদা জিয়ার আমলে ততটা নয়। অনেকে বলতে পারেন খালেদা জিয়া ততটা সময় পাননি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকেননি। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিএনপি সরকার যেভাবে মূল্যায়িত করেছিল, দেখেছিল তা ছিল অপরিণত ও বিতর্কিত। বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতাকে বিএনপি সরকারের আংশিক দেখা ও দেখানোর এই অপচেষ্টা, সংকীর্ণতা সাধারণ মানুষের ভেতর নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছিল। যে বিপ্লব ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। বিশেষ করে তরুণদের ভেতর। ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা খালেদা জিয়ার সরকারের পতনের অন্যতম একটা কারণ ছিল অনেকেই মনে করেন। যদিও বর্তমানে বিএনপি রাজনৈতিক সংগঠনটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগ ছুড়ে মারলেও এই অভিযোগটি বিএনপির বেলায়ও বর্তায়, প্রযোজ্য হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাসে তার নজির আছে। শুধু বিরোধিতার জন্যই বিরোধী দল, এই মানসিকতাই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে এক হয়ে দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে বাধা দিয়েছে, দিচ্ছে। বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাস ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বেশ ক’বার। বড় ক্ষতটা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই দিন একজন মহান ব্যক্তি নয়, একটা দেশকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয়েছিল। বাঙালি জাতির পরাধীনতার পুনরুত্থান ঘটানোর অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। যে লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন সেটাকে ধূলিসাৎ করার বিরাট ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ছিল সেই পাশবিক ঘটনাটি। সেই কলঙ্কিত ঘটনার পরবর্তী অবস্থার মধ্য দিয়ে বিএনপি নামক রাজনৈতিক সংগঠনটির উত্থান। নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে সরিয়ে ফেলা, বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দেয়া ছিল বিএনপি রাজনৈতিক সংগঠনটির চরম সংকীর্ণতা। বিএনপি সরকার আমলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত না হওয়া, ছবি প্রদর্শিত না হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না, বিজয়কে সম্মানিত করে না। এটা দলটির এক ধরনের ইচ্ছাকৃত কৌশল ছিল, অনিচ্ছাকৃত নয়। এ কথা বলা যাবে না যে, বিজয়ের ৫০ বছরে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত ও নিরাপদ হতে পেরেছে দেশ ও জাতি। তবে শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতটা আপসহীন ও জিরো টলারেন্স নীতি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন এবং নিজের সংগঠন ও সরকারের ভেতর সেই নীতির যতটা প্রবেশ ঘটিয়েছে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, খালেদা জিয়া তা পেরে ওঠেননি। অনেকের ধারণা, তারেক জিয়ার কারণেই তা সম্ভব হয়নি। তারেক জিয়ার হাওয়া ভবন তখন অনেক ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করত বলে অনেকে মনে করেন। আর তাছাড়া আওয়ামী সরকার আমলে যেভাবে দুর্নীতির সংবাদ প্রচার হয়েছে, হচ্ছে বিএনপি সরকার আমলে তা হয়নি। হতে দেখা যায়নি। তার মানে এই নয় যে, বিএনপি সরকার আমলে দুর্নীতি হয়নি। হয়েছে তো বটেই। তবে সেই অনুপাতে তার সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। আমরা দেখেছি নিজ সংগঠন কিংবা সরকারের ভেতর দুর্নীতি করেছেন তা জানার পর এমন কাউকেই শেখ হাসিনা ছাড় দেননি। ত্রাণ বিতরণের সময় স্থানীয় প্রতিনিধি ও প্রশাসনকে তিনি প্রকাশ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন তারা অনিয়ম না করেন। পাবলিকলি এভাবে খালেদা জিয়া সম্ভবত নিজ সরকারের স্থানীয় প্রশাসন কিংবা নেতাকর্মীদের বলেননি। আর বলে থাকলেও সেই তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেনি হয়তো বা। তবে এ কথা ঠিক যে, শেখ হাসিনার সতর্কতা সবাই শুনেননি, মানেননি। শুনছেন না, মানছেন না। তার কঠোর হুঁশিয়ারির পরও প্রশাসন ও সংগঠনের ভেতর কেউ কেউ দুর্নীতি ও অনিয়ম করে চলেছেন। খালেদা জিয়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একজন আপসহীন নেত্রী ছিলেন। এই বিষয়টিই তার রাজনৈতিক জীবনের বড় অর্জন ছিল। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেও তার সরকার স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে অবস্থান নিতে পারেনি। আবার শেখ হাসিনা তার পিতার হত্যাকারীদের বিচারকার্য সম্পাদন করতে সমর্থ হলেও খালেদা জিয়া তার শাসনামলে স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ায় এগিয়েছেন কিংবা হত্যার বিচার দাবির আওয়াজ করেছেন বলে জানা নেই। এমনকি তারেক জিয়া ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজনৈতিক সংগঠনটি যতটা আন্দোলনমুখর হয়েছে এবং হচ্ছে, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা নেতা জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচারের দাবিতে কিন্তু সংগঠনটি সোচ্চার হয়নি। তেমন দেখা যায়নি। এখনো সংগঠনটির পক্ষ থেকে তেমন আওয়াজ ওঠে না। কথাটা দুঃখজনক হলেও সত্য। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও তিনি বাসায় অবস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। তার চিকিৎসা চলছে। অনেকে মনে করেন যে, এটা শেখ হাসিনার মহানুবতা ও মানবতা। যদিও সংগঠনটির ভেতর থেকে সম্প্রতি উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ পাঠানোর দাবি উঠেছে এবং খালেদা জিয়ার কিছু হলেও আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলনের হুমকিও দেয়া হয়েছে। আন্দোলন চলছে। পাশাপাশি যদি দেখা যায় বিএনপি সরকার আমলে ২১ আগস্টের সিরিজ গ্রেনেড হামলা, যার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, তাতে কিন্তু খালেদা জিয়ার মহানুভবতা কিংবা মানবতার কথাটি উচ্চারিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। বিএনপির আমলে শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার চেষ্টা চালানো হয়েছে, কিন্তু আওয়ামী সরকার আমলে খালেদা জিয়াকে এমন নৃশংসভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে বলে জানা নেই। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বলতে পারি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাল্লার ভারটি শেখ হাসিনারই। যিনি আপাদমস্তক স্বাধীনতার স্বপক্ষের এক ব্যক্তিসত্তা।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App