×

মুক্তচিন্তা

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা : মানবিক রাজনীতির জয় হোক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:৫৬ এএম

২০২০ সালের শুরু থেকে সমগ্র বিশ্ব যখন করোনা সংক্রমণে টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছিল তখন বাংলাদেশও সেই অবস্থার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এই অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা বর্তমান সরকারকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। মর্ম দিয়ে সে সময় এই বিপর্যয়কে উপলব্ধি করেছিল বলেই রাষ্ট্রীয় নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকার একাধিক মামলার দণ্ডিত আসামি বেগম খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিল। সরকারের এই উদ্যোগকে অনেকেই তখন স্বাগত জানিয়েছিলেন। রাজনীতি ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এই মানবিক মহানুভবতা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তার এই মানবিক মহানুভবতার কাছে প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত ধারার ‘রাজনীতি’ সেদিন হার মেনেছিল। বিজয়ী হয়েছিল মানবিকতা, বিজয়ী হয়েছিল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ঔদার্যপূর্ণ মহানুভবতা। আমরা জানি, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার জনকল্যাণমুখী রাজনীতিকে এ দেশের মাটি থেকে চিরতরে উৎখাতের লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়া এবং তদীয়পুত্র তারেক রহমান হেন চেষ্টা নেই যা করেননি। শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতিই নয়- মানসিকভাবেও শেখ হাসিনাকে বিপর্যস্ত করার জন্য বেগম জিয়া হঠাৎ করেই ১৯৯৬ সালের পর থেকে ১৫ আগস্টকে নিজের ‘বানিয়ে তোলা জন্মদিন’রূপে ঘটা করে উদযাপন আরম্ভ করেন! বিএনপির লক্ষ্য ছিল বিষাদময় ১৫ আগস্ট তথা বঙ্গবন্ধুর শেষ স্মৃতিটুকু পর্যন্ত এ দেশের মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা! ১৫ আগস্টের অনুরূপ ২১ আগস্টের মতো আরো একটি নারকীয় দিনও সৃষ্টি করেছিল বিএনপি। সক্রিয় হয়েছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেও! কিন্তু শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পথে হাঁটেননি। দেশের প্রচলিত আইনকে সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি সম্মান জানিয়েই সব অন্যায়ের বিচার দাবি করেছেন। আর এ দেশের মানুষের ভালোবাসার ওপর আস্থা রেখেছেন। শেখ হাসিনাকে হত্যা-চেষ্টাকারীদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত, আওয়ামী লীগকে ধ্বংসকারী হিসেবে পরিচিত এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডিত বেগম জিয়াকে নির্বাহী ক্ষমতা বলে মানবিক কারণে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছেন জননেত্রী। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে তাকে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে মুখর হচ্ছে। আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে বিদেশে বেগম জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আমাদের মনে হয়। বেগম জিয়াকে নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয় এবং অতি-উৎসাহী নেতৃবর্গ যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবেন তা মোকাবিলার সক্ষমতাও বর্তমান সরকারের আছে বলে আমাদের বিশ্বাস। তাই সরকার আইনি ব্যবস্থাকে ঊর্ধ্বে রেখে রাষ্ট্রীয় নির্বাহী আদেশে পুনরায় মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে বেগম জিয়াকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের অনুমতি দিতে পারেন। এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবেও জয়লাভ করবে, মানবিকতার উদার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমেও বিজয়ী হবে। আওয়ামী লীগ মানুষের মন জয় করেই পরপর তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষে, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল হিসেবে, বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির শত-সহস্র অপরাধ সত্ত্বেও শুধু ‘অসুস্থ’ বিবেচনায় বেগম জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার ‘সুযোগ’ দেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাতেই পারেন। আমরা মনে করি এতেও জননেত্রীর নেতৃত্বগুণের মহিমা সুসংহত হবে। রাজনীতি এবং মানবিকতায় বিজয়ও অর্জিত হবে। আসন্ন নববর্ষে এমন একটি নির্বাহী আদেশ আমরা দেখতেও পারি হয়তো। কোভিড-১৯ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। কোভিডের ছোবল অনেক দেশের তুলনায় কম হলেও বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ এখনো কোভিড-মুুক্ত হতে পারেনি। যদিও উন্নত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সরকার কোভিড নিয়ন্ত্রণে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে, তবু এখনো দৈনিক শনাক্তের হার একের ওপরেই আছে। মাঝেমধ্যে মৃত্যুশূন্য দিন দেখলেও আমরা নিয়মিত মৃত্যু দেখছি এক থেকে পাঁচের মধ্যে। সাম্প্রতিককালে ওমিক্রন নামের নতুন ভ্যারিয়েন্ট সক্রিয় হওয়ায় পুনরায় আশঙ্কা বাড়ছে। ইউরোপের অনেক দেশ ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে আবারো লকডাউন ব্যবস্থাপনার মধ্যে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ওমিক্রনের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার বিষয়ে সচেতন রয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আপাতত সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলেই আমরা জানি। দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে যে দুজন ওমিক্রন আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা এখন সুস্থ আছেন। এও জানি যে, তৃতীয় আর কোনো ব্যক্তির মধ্যে ওমিক্রন এখনো সংক্রমিত হয়নি। ইতোমধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন আর দুই ডোজ সম্পন্ন হয়েছে এরূপ পরিসংখ্যানও চার কোটির ওপর। করোনার প্রকোপ কমায় ভ্যাকসিন প্রদান এবং গ্রহণে কিছুটা শৈথিল্যও আমরা টের পাচ্ছি। কোনোরূপ শৈথিল্য প্রকৃতই যদি থেকে থাকে তবে দ্রুত তা দূর করা উচিত। ২০২০-এর মার্চ থেকে শুরু হওয়া অদৃশ্য ত্রাস করোনা মহামারি এবং মহামারির ভীতি ২০২১-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধির নানা অনুষঙ্গে ব্যতিব্যস্ত থাকতে থাকতে এবং বেশির ভাগ মানুষ তা অমান্য করতে করতে যেভাবে জীবনযাপন করেছি তা যে স্বাভাবিকতার ব্যতিক্রম ছিল সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অস্বাভাবিক জীবনযাপন আমাদের মনোজগতকে নেতিবাচকভাবে আলোড়িত করেছে। ফলে বিদায়ী ২০২১-সহ পূর্ববর্তী ২০২০-এরও অধিকাংশ সময়ে আমরা যে জীবন বাধ্য হয়ে যাপন করেছি তা আমাদের মানসিকতাসহ জীবনভাবনাকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই পরিবর্তন কেবল ব্যক্তিক বোধ, অনুভূতি বা উপলব্ধিই নয়- সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থাকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। করোনা মহামারি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতকেও নেতিবাচক প্রভাবে জর্জরিত করেছে। তবু এর মধ্যেই আমরা জীবনযাপন করেছি। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত করেছি। যতটুকু দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিকভাবে চলা সম্ভব সে চেষ্টা কারো কারো মধ্যে না থাকলেও অনেকের মধ্যেই ছিল। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় সরকারও দৃঢ়তার সঙ্গে চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার জোগানকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কিছুটা আপসকামী হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সরকার যে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছে তা বৈশ্বিকভাবেও স্বীকৃত। তবে, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ ‘কভারেজ’ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অধীন বিভিন্ন সংস্থার উদাসীন মনোভাব এবং দুর্নীতির চিত্রও বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলে আসে। মানুষ বুঝতে পারে স্বাস্থ্যসেবা খাতে আমাদের উন্নতির অনেক অবকাশ এখনো রয়েছে। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে চৌকশ ও যুগোপযোগী করতে হবে। এ খাতের বৈষম্যও দূর করতে হবে। একই সঙ্গে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে কোনো বিধিবিধানের বালাই নেই! প্রত্যেকেই নিজেদের ইচ্ছামাফিক চলে। মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চেয়ে ‘ব্যবসায়িক’ মনোবৃত্তিই সেখানে প্রকট। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাত ‘ব্যবসায়িক’ হলেও সেখানকার শৃঙ্খলা এবং সেবার মান ঈর্ষণীয়। স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট ব্যবসাকে তারা এতটাই ‘প্রফেশনাল’ এবং উন্নত ও মানসমৃদ্ধ করেছে যে, বাংলাদেশের সাধারণ মধ্যবিত্তও এখন আর দেশের ভেতর চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ পায় না। প্রায় সম-পরিমাণ অর্থেই দেশের চেয়ে কয়েকগুণ উন্নত, মানসম্মত এবং ‘যথাযথ’ চিকিৎসাসেবা ভারতের অনেক স্থানেই পাওয়া সম্ভব। আর যারা একটু বেশি পয়সা খরচ করে আরো উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে চান তারা সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান। মোটকথা, এ দেশের মানুষ নিজের দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণে ‘যথাযথ ভরসা’ পায় না। চিকিৎসাসেবা খাতে সক্ষমতাও আমাদের দেশে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। তাই সবার মধ্যেই বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের তৎপরতা দেখা যায়। বেগম জিয়ার পরিবারও এই প্রবণতার বাইরে নয়। করোনার বিপর্যস্ত কালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে বহুগুণ। নানা রকমের অসংলগ্ন এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের মনোজগতে করোনা এক ধরনের বৈকল্য সৃষ্টি করেছে। এই বৈকল্যই সামাজিক জীবনযাপনের নানা অসঙ্গতির মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই শেষ হতে যাচ্ছে খ্রিস্টীয় বর্ষ ২০২১। জীবনের সঞ্চয় থেকে আরো একটি বছর খরচ হয়ে গেল আমাদের। বিদায় নিতে যাচ্ছে ২০২১। অনেকেই বিগত বছরের জমা-খরচ-ইজারা হিসাব-নিকাশ করেন। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খেরো খাতা সামনে নিয়ে ভাবতেও বসেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। কেউ আবার হারানো ও বিগত বিষয় নিয়ে ভাবতে চান না, মাথাও ঘামান না। কিন্তু প্রত্যেকের মনে এমন এক সুপ্ত বাসনা বিরাজ করে যে, বিদায়ী বছরের তুলনায় নতুন বছর নানা দিক দিয়ে আরো সাফল্য নিয়ে আসবে, আরো সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। নতুন বছর প্রতিটি মানুষের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য। ব্যক্তিগত জীবন ছাপিয়ে এই সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় জীবনকে আপ্লুত ও আচ্ছন্ন করুক। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App